Feeds RSS

Friday, December 11, 2009

খনা কাহিনী - ৩

প্রচলিত গল্পে খনা ছিলেন লঙ্কাদ্বীপের রাজকুমারী। মতান্তরে রাক্ষসকবলিত কোনো এক রাজ্যের অনিন্দ্যসুন্দর রাজকুমারীর নাম ছিল লীলাবতী যিনি পরে খনা নামে পরিচিত হন। খনা অর্থ বোবা এবং জিহ্বা কর্তনের পর নামটি প্রতিষ্ঠা পায়। কথিত আছে, জ্যোতিষশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞানের ফলে খনা প্রায়ই রাজসভাতে আমন্ত্রিত হতেন। ফলে প্রতিহিংসাপরায়ণ শ্বশুর বরাহ মিহির ছেলে মিহিরকে লীলাবতীর জিহ্বা কাটার নির্দেশ দেন। বাবার নির্দেশে মিহির খনার জিহ্বা কর্তন করেন। তবে গল্পমতে কথিত রাজকন্যা স্বামীর কাছে অনুরোধ করেন যে, জিহ্বা কর্তনের আগে কিছু বলতে চান। স্বামী অনুমতি দেন। এ সময় খনা আবাদ, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, যাত্রা, গবাদি, শস্যাদি, ফলাদি, গ্রহ-নক্ষত্রাদি সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত বচন দেন যা পরে খনার বচন নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়। খনার বচন সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কৃষক সামজে; যাদের কোনো লিখিত ভাষা নেই। মুখে মুখে প্রচলিত এসব ভাষা যুগ যুগ ধরে তাদের কৃষিকাজ এবং জীবনাচারে প্রভাবিত হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে সোজা চোখে না দেখলেও খনার বচন তার অবশ্যম্ভাব্যতা থেকে কক্ষচ্যুত হয়নি। বরং গ্রামের কৃষকরা বিজ্ঞানের ভাষার চেয়ে প্রবাদ-প্রবচনে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তবে অনেক বিজ্ঞজন খনার বচনকে আধুনিক বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করতে গিয়ে প্রবচনগুলো খনার বিজ্ঞান হিসেবে অভিজ্ঞান করেন। বচনগুলো অষ্টম অথবা নবম শতাব্দীতে রচিত। তবে আজো তা নির্ভুল ও সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন নীতিবাক্য হিসেবেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। যেখানে ঋতুভেদে শস্য উৎপাদন, আবহাওয়ার উপলব্ধি সন্নিবেশিত হয়েছে এবং মাঝে মাঝে ভবিতব্য নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে।
‘যদি বর্ষে আগনে/রাজা যায় মাগনে/ যদি বর্র্ষে পুষে/ কড়ি হয় তুষে/যদি বর্ষে মাঘের শেষ/ধন্য রাজা পুণ্য দেশ’ অর্থাৎ যদি অগ্রহায়ণে বৃষ্টি হয় তবে দুর্ভিক্ষে রাজাকে ভিক্ষা করতে হবে। পৌষ মাসে বৃষ্টি হলে তুষ বিক্রি করেও টাকা হয়, আর মাঘের শেষ দিন বৃষ্টি হলে রাজার ভা-ার শস্যে পূর্ণ হয়। কিংবা ‘যত জ্বালে ব্যঞ্জন মিষ্ট/তত জ্বালে ভাত নষ্ট’ অর্থাৎ মিষ্টি যত জ্বালানো যাবে তত ভালো, আর ভাত যত জ্বাল দেয়া যাবে তত নষ্ট হবে।
খনা তার প্রবাদে মাঝে মাঝে প্রাচীন ইতিহাসের কথা উল্লেখ করেছেন। শুভ-অশুভ দিনক্ষণ নিয়ে ভবিষ্যতের কথা চিরন্তন ভাষায় বলেছেন। ‘যদি না হয় আগনে বৃষ্টি/তবে না হয় কাঁঠালের সৃষ্টি’ অর্থাৎ অগ্রহায়ণে বৃষ্টি না হলে কাঁঠালের ফলন ভালো হবে না।
কৃষিকাজে খনার বচনে অনেক নির্দেশনা আছে যা আধুনিক কৃষিবিজ্ঞানের সঙ্গে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। ‘হাত বিশ করি ফাঁক/আম কাঁঠাল পুঁতে রাখ’ কিংবা ‘গাছগাছালি ঘন সবে না/গাছ হবে তার ফল হবে না’ কিংবা ‘খনা ডেকে বলে যান/ রোদে ধান ছায়ায় পান’ কিংবা ‘ষোল চাষে মুলা/ তার অর্ধেক তুলা/তার অর্ধেক ধান/ বিনা চাষে পান।’ গবাদিপশু নিয়ে খনা অনেক অনুভূতিপ্রবণ বচন রচনা করেছেন। ‘যে চাষা খায় পেট ভরে/গরুর পানে চায় না ফিরে/গরু না পায় ঘাস পানি/
ফলন নাই তার হয়রানি’ কিংবা ‘গরুর পিঠে তুললে হাত/ গিরস্তে কবু পায় না ভাত।’ প্রকৃতিবিষয়ক প্রবচনে তিনি মানুষের জন্য সাবধান বার্তা ঘোষণা করেছেনÑ ‘আলো হাওয়া বেঁধো না/রোগে ভোগে মরো না।’
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের ‘ঊধৎষু ঃড় নবফ, ধহফ বধৎষু ঃড় ৎরংব, সধশবং ধ সধহ যবধষঃযু, বিধষঃযু ধহফ রিংব’ সেই বিখ্যাত উক্তির বহু আগে খনা লিখে গেছেনÑ ‘সকাল শোয় সকাল ওঠে/তার কড়ি না বৈদ্য লুটে’ অর্থাৎ যে আগে শয্যায় যায় এবং আগে শয্যা পরিত্যাগ করে তার জন্য ডাক্তারের প্রয়োজন হয় না। এবং সব সমালোচনার উত্তর আছে। বর্তমানে বাংলাদেশে চালু হওয়া ‘উধুষরমযঃ ংধারহম ঃরসব’ পদ্ধতিও তার সমর্থক।
লেখাটি পদ্মা পাড়ের মানুষ থেকে নেওয়া

0 comments:

Post a Comment