‘খনা’ ছদ্মনামের এক বিদুষী নারী যার অন্য নাম লীলাবতী। তার জীবনের গল্পটা বেশ পুরোনো, বন্দি তিনি কিংবদন্তীর মায়া দেয়ালে। সেই দেয়াল টপকে তবু তাকে যতোটা বুঝতে পারা যায় তাতে বোধ হয় তিনি এক বিদুষী জ্যোতিষী। খনার স্বামী মিহিরও একই বৃত্তিধারী। শ্বশুর যশস্বী বরাহ মিহির। পুত্রজায়ার যশ, খ্যাতি ও বিদ্যার প্রভাব দর্শনে প্রকাশ পায় বরাহের হীনম্মন্যতা ও ঈর্ষা। শ্বশুরের নির্দেশে লীলাবতীর জিহ্বা কর্তন ও তার ‘খনা’ হয়ে ওঠার গল্প পেরিয়েছে প্রজন্মের সীমানা।
চন্দ্রকেতু গড়, যেখানে আজো আছে খনা মিহিরের স্মৃতিচিহ্ন। বরাহ মিহির বানহন্ডার দেউলনগর বা দেউলানগরের রাজা ধর্মকেতুর রাজজ্যোতিষী। পুত্র মিহিরের জন্মকোষ্ঠী ভুল গণনা করে তাকে একেবারে ভাসিয়েছিলেন বিদ্যাধরীর জলে। সেই হতভাগা মিহিরকে নিয়ে খনা হাজির ইন শ্বশুর বরাহের সামনে, চরমভাবে বুল প্রমান করেন বরাহের গণনা। সেই সুবাদে ধর্মকেতুর রাজসভা পরিচিত এবং প্রশংসিত হন মিহির ও লীলাবতী। দু’জনেই রাজ সভাসদ পদও লাভ করেন। পুত্রবধূর এমন ঝলমলে উত্থান মেনে নিতে পারেন না বরাহ। অন্যদিকে খনা মুক্ত প্রাণের টানে বাধনহারা হয়ে মিশে চলেন নতুন দেশের নতুন মানুষদের সাথে। প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় শাসককুলের সামনে। লেখ্য ভাষ্যহীন প্রাকৃতদের কৃষি সংক্রান্ত জ্ঞানের রাজ্যকে বিকাশে গেঁথে চলেন বচনের পর বচন, যা কৃষকের মুখে আজো টিকে আছে তার শাশ্বত প্রাণ নিয়ে। বরাহ চেষ্টা করেন লীলাবতীকে বশে আনার। কিন্তু লীলা চলছেন নিজের ইচ্ছেমতো। লীলার অবাধ্যতায় ক্রুব্ধ বরাহ পুত্রকে আদেশ করেন লীলার জিহ্বা কর্তন করে তাকে যেন উৎসর্গ করা হয়। খনার বচনের মাঝে টিক থাকা শত বছরের জল, মাটি, ফসল আর শ্রমমুখর মানুষের গন্ধ মাখা জ্ঞান আর সত্যটুকু কি সত্যি লীলাবতীর নাকি এ সত্য তথ্য সবই এ ভূখণ্ডের বৃষ্টি, পলি, আলো আর জল হাওয়ার সাথে মিশে থাকা যুগান্তরের সামষ্টিক জ্ঞানের সংকলন? এমন বর্বরোচিত নির্মম পরিণতি লীলাবতীর একি শুধুই একজন বলেই, নাকি নারী হয়েই তিনি চাষাভুষোর সাথে মিশেছেন বলে, সেই তার কাল? পুরুষতন্ত্র না শ্রেণী কাঠমো; নাকি উভয় দাঁড়ানো লীলাবতীর বিপ্রতীপে? স্বামী মিহির বা প্রাকৃত লোকালয় কারো পরোয়া না করে। সকল পিছুটানের মায়া শেকল ভেঙে নিজেকে খনা নিয়ে যান দিগন্তের ওপারে। শুধু স্বাক্ষী হয়ে থেকে যায় পথে প্রান্তরে কৃষকের মুখে মুখে খনার শান্ত সঙ্গগুলো। তবু প্রশ্ন দানা বাঁধে মনে খনার সত্যিই কি একক সত্য, নাকি আজকে যা নির্ভুল কাল তাই হতে পারে অসত্য? কেবলই সত্যের পথে দাঁড়ানোর যে মৃত্যুনেশা তার সে নেশা কি একরোখা জেদ? এভাবে খনা নিজেকে নিজেই করেছেন প্রশ্নের সম্মুখীন।
Thursday, April 1, 2010
Subscribe to:
Posts (Atom)