০১.
‘মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা’ কিংবা ‘কলা রুয়ে না কাটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত’ অথবা ‘বেঙ ডাকে ঘন ঘন, শীঘ্র হবে বৃষ্টি জান’ বা ‘বামুন বাদল বান, দক্ষিণা পেলেই যান’, এগুলো জনপ্রিয় খনার বচন। কৃষিভিত্তিক জন-মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত এরকম বহু লোক-বচনের সাথেই আমরা পরিচিত। খনার বচনও আছে প্রচুর। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের লোক-সাহিত্যে খনা নামে কেউ কি আদৌ ছিলেন ? আসলে এ প্রশ্নটাও বিভ্রান্তিমূলক। কেননা লোক-সাহিত্য বলতেই আমরা বুঝে নেই যে, লোক-মুখে প্রচলিত সাহিত্য অর্থাৎ জনরুচির সাথে মিশে যাওয়া যে প্রাচীন সাহিত্য বা সাহিত্য-বিশেষের কোন সুনির্দিষ্ট রচয়িতার সন্ধান আমরা পাই না বা জানা নেই তা-ই লোক-সাহিত্য। সাহিত্যে যেহেতু রয়েছে, রচয়িতা আছে তো বটেই। কিন্তু তা লিপিবদ্ধ ছিলো না বলে কাল-চক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া এই রচয়িতারা নাম-পরিচয় হারিয়ে চিহ্ণহীন লোকায়ত পরিচয়ে চিরায়ত জনস্রোতের অংশ হয়ে গেছেন। তাঁদের লিপিহীন মহার্ঘ রচনাগুলো হয়ে গেছে আমাদের সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ, অনেক গবেষক-সংগ্রাহকদের গভীর শ্রমসাধ্য অবদানে কালে কালে সংগৃহীত ও সংরক্ষিত হয়ে যাকে আমরা আজ লোক-সাহিত্য বলে চিহ্ণিত করছি।
লোক-সাহিত্যের এই প্রাথমিক ও অনিবার্য বৈশিষ্ট্য স্বীকার করে নিলে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে এ সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে, খনার বচন বিশুদ্ধ লোক-সাহিত্যের অংশ হতে পারে কি না, নয়তো লোক-সাহিত্যে খনা নামের সুনির্দিষ্ট কোন একক রচয়িতা থাকতে পারে কি না। এক্ষেত্রে যেকোন একটি সম্ভাবনা সত্য হওয়া সম্ভব। পরস্পর-বিরোধী দুটো সম্ভাবনা একইসাথে সত্য হতে পারে না। তাহলে কোনটি সত্য ?
‘খনা’ নামে কেউ থাক বা না থাক, খনা (khona) নাম বা শব্দটি যে আজ কিংবদন্তী, তা নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবেন না। গ্রামে গঞ্জে কৃষি-সম্পৃক্ত আমাদের প্রাচীন প্রবীন গুরুজনেরা এখনো খনা’র কৃষিতত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন কালজয়ী বচনের মাধ্যমে অন্যদেরকে জ্ঞানদান করে থাকেন। জলবায়ু ও প্রকৃতির সাথে কৃষির নিবিড় সম্পর্ক অনস্বীকার্য। এই সম্পর্কগুলো খনার বচনের মধ্য দিয়ে যে অব্যর্থ সূত্রাবদ্ধতা পেয়ে গেছে, তাকে কালোত্তীর্ণের মর্যাদা না দিয়ে উপায় নেই। কিন্তু তাতে করে খনা নামের কোন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিপরিচয় প্রমাণসিদ্ধ হয় না। বর্তমানে সংগৃহীত খনার এই আদি বচনগুলোর এরূপ কোন প্রমাণসিদ্ধ লিপিবদ্ধতা না থাকায় জনভাষ্যের কালপরিক্রমায় সেগুলোর অঞ্চল ও ভাষাভিত্তিক বহু ভ্রংশ-উপভ্রংশ ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়। ফলে এগুলোর আদিরূপ জানার কোন উপায় আর অবশিষ্ট নেই। এছাড়া জনমানুষের মুখে মুখে জনশ্রুত বচনগুলোয় যে কোনো একজন খনার গুটিকয় বচনের সাথে কালে কালে আরো বহু খনার প্রাকৃতিক রচনার সম্মিলন ঘটে নি, তা-ই বা কে বলবে ? বরং কালে কালে কৃষিভিত্তিক সমাজ-সংশ্লিষ্ট বহু জনের বহু অভিজ্ঞতার সমন্বয় সাধনের মধ্য দিয়ে একটা সম্মিলিত মাত্রা পাওয়া এই শ্লোকসদৃশ জমাট রূপটিকেই অধিক যুক্তিসংগত বলে মনে হয়। তাই খনার বচন বলতে আমরা যদি খনা নামের কোন একক ব্যক্তিবিশেষের রচনা না বলে বিভিন্ন কালের বিভিন্ন জনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞানের জমাটবদ্ধ সম্মিলিত রচনা বলে বিবেচনা করি, তা কি খুব অযৌক্তিক হবে ?
০২.
জনভাষ্যের রহস্যময় প্রতিনিধিত্বকারী এই প্রতীকী চরিত্র খনা আসলে কি কোন মিথ-আশ্রয়ী চরিত্র ? ঢাকা ‘নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা’ প্রকাশনী থেকে ২৩ মে ১৯৯৫, ০৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪০২-এ একশ’টি বচনের সমন্বয়ে ‘খনার বচন’ নামে প্রকাশিত হাতের মুঠোয় পুরে ফেলার মতো ক্ষুদ্রাকৃতির বইটির ‘বিদূষী খনা’ শিরোনামে গ্রন্থিত ভূমিকাতূল্য লেখাটিতে কিছু মজার বিষয় লক্ষ্য করা যায়। ‘খনা যে প্রাচীন বাংলাদেশের একজন বিদূষী খ্যাতনাম্নী জ্যোতিষী ছিলেন, সে সম্পর্কে সন্দেহের আর কোন অবকাশ নেই’ বলে সন্দেহমুক্ত করতে নিশ্চয়তাবিধানের যে প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে, তাতে কি আমরা আসলে সন্দেহমুক্ত হতে পারি ? ওখানে আবার বলা হচ্ছে- ‘খনা সম্পর্কে বাংলা ও উড়িয়া ভাষায় কিংবদন্তী আছে। গল্প দুটি প্রায় একরকম কিন্তু একটি মূল জায়গায় মত-পার্থক্য আছে।’ কী সেই মত-পার্থক্য ? তা বুঝতে আমাদেরকে উপরোক্ত বই অনুসরণে কিংবদন্তীয় গল্পটি সম্পর্কে আগে একটা ধারণা নিতে হয়।
কিংবদন্তী:
‘খনা ছিলেন লংকাদ্বীপের রাজকুমারী। লংকাদ্বীপবাসী রাক্ষসগণ একদিন স্ববংশে তাঁর পিতা-মাতাকে হত্যা করে এবং তাঁকে হস্তগত করে। একই সময়ে উজ্জয়িনীর মহারাজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার প্রখ্যাত জ্যোতিষ পণ্ডিত বরাহ তাঁর ভুল গণনায় স্বীয় নবজাত শিশু সন্তান মিহির-এর সহসা অকাল মৃত্যুর কথা জেনে নবজাতককে একটি তাম্র-পাত্রে রেখে স্রোতে ভাসিয়ে দেন। জ্যোতিষ গণনায় তিনি মনে করেছিলেন এভাবে শিশুটি মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে। পরিত্যক্ত এই শিশুকেও ভাসমান তাম্র-পাত্র থেকে রাক্ষসেরা তুলে নেয় এবং দুটো শিশুকে একসাথে পালন করতে থাকে।
খনা ও মিহির কালক্রমে জ্যোতিষ শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন এবং যৌবনে পরস্পর পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। খনা খগোল শাস্ত্রেও পারদর্শী হয়ে ওঠেন। একদিন খনা ও মিহির গণনায় অবগত হলেন যে, মিহির উজ্জয়নীর সভাপণ্ডিত বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহের পুত্র। এক মাহেন্দ্রক্ষণে উভয়ে রাক্ষস গুরুর অনুমতিক্রমে এবং একজন অনুচরের সহায়তায় পালিয়ে ভারতবর্ষে যাত্রা করেন। উজ্জয়িনীতে এসে খনা ও মিহির পণ্ডিত বরাহের নিকট আত্মপরিচয় দেন। কিন্তু পণ্ডিত সে কথা বিশ্বাস করতে চাইলেন না। কারণ তিনি গণনা দ্বারা জানতে পেরেছিলেন যে, এক বছর বয়সেই তাঁর পুত্র মিহিরের মৃত্যু ঘটবে। খনা তখন তাঁর একটি বচন উদ্ধৃতি দিয়ে শ্বশুরের ভুল গণনা প্রতিপন্ন করেন-
‘কিসের তিথি কিসের বার, জন্ম নক্ষত্র কর সার
কি করো শ্বশুর মতিহীন, পলকে আয়ু বারো দিন।’
অর্থাৎ এ গণনায় মিহিরের আয়ু ১০০ বছর। পণ্ডিত বরাহ সানন্দে খনা ও মিহিরকে স্বগৃহে গ্রহণ করেন। এদিকে পালাবার পর দ্বীপনেতা পলাতক দম্পতিকে ধরার জন্যে আয়োজন করেছিলেন। তখন খনা-মিহিরের ওস্তাদ বলেন যে, ওরা জ্যোতিষী গণনা দ্বারা এমন এক অনুকূল মুহূর্তে পলায়ন করেছেন যে, তারা নিরাপদে পৌঁছে যাবেন। ফলে অনুসন্ধান পরিত্যক্ত হয়।
ক্রমে খনার অগাধ জ্ঞানের কথা জানাজানি হয়ে যায়। রাজসভাতে তিনি আমন্ত্রিত হন। খনার জ্ঞান-গরিমা সভা-পণ্ডিতদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি তিনি পণ্ডিত বরাহের জ্যোতিষশাস্ত্রীয় বহু দুঃসাধ্য সমস্যা সমাধান করে দিতে লাগলেন। এতে অপমানিত ও ঈর্ষান্বিত পণ্ডিত বরাহ পুত্র-বধুকে জিহ্বা কর্তন করে তাকে বোবা বানিয়ে দেয়ার জন্য পুত্রকে আদেশ করেন। মিহির খনাকে একথা সবিশেষ জানান। খনা এ শাস্তি মেনে নেন। পিতৃ-আদেশে মিহির এক তীক্ষ্ণধার ছুরিকা দ্বারা খনার জিহ্বা কর্তন করেন। মাত্রাধিক রক্তক্ষরণে অসামান্যা বিদূষী খনার মৃত্যু হয়। খনার কর্তিত জিহ্বা ভক্ষণ করে টিকটিকি গুপ্ত জ্ঞান লাভ করে।
উড়িয়া কিংবদন্তী অনুযায়ী খনার আসল নাম ছিল লীলাবতী। শ্বশুর বরাহ তার পুত্র মিহিরকে আদেশ করেছিলেন পুত্রবধুর জিহ্বা কেটে ফেলতে। তাই সে ‘খনা’। আসলে লীলাবতী ও খনা একই ব্যক্তি হতে পারেন। তবে দুটো গল্পেরই সারমর্ম এক: খনার মৃত্যুর কারণ ছিল তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা।
উড়িয়া কিংবদন্তী অনুযায়ী পিতার আদেশ পেয়ে নিরূপায় স্বামী মিহির খনার জিহ্বা কর্তনের পূর্বে কিছু কথা বলার সুযোগ দিয়েছিলেন। খনা তখন কৃষি, আবহ-তত্ত্ব, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় এবং মানবজীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বহুবিধ কথা বলে যান। পরবর্তীকালে সে সব কথা ‘বোবার বচন’ বা খনার বচন’ নামে অভিহিত হয়।
খনা সিংহলের রাজকুমারী হলেও বাংলাদেশের সাথে তার সম্পর্ক-সূত্র পাওয়া যায় বিভিন্ন ইতিহাসে। ফলে খনার ভাষা বাংলা হওয়া খুব অবাস্তব নয়। তবে খনার বচনের বর্তমান ভাষা মূল ভাষার বিবর্তিত রূপ। তাঁর আবির্ভাব কাল সম্পর্কে ধারণা করা যায় সম্ভবত তিন চারশ’ বর্ষের মধ্যে হয়েছিল।’
‘খনার বচন’ পুস্তিকার উপরোক্ত রূপকথা জাতীয় গল্প ও একপেশে অনুসিদ্ধান্তটি পড়ে খনা নামের সুনির্দিষ্ট কারো অস্তিত্বের স্বপক্ষে স্পষ্ট ও যৌক্তিক কোন সিদ্ধান্তে আসা কি সম্ভব ?
খনা বিষয়ক অন্য এক কিংবদন্তী অনুসারে তাঁর নিবাস ছিলো পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসাতের দেউলি গ্রামে। পিতার নাম অনাচার্য। চন্দ্রকেতু রাজার আশ্রম চন্দ্রপুরে তিনি বহুকাল বসবাস করেন। কিন্তু কিংবদন্তী তো কিংবদন্তীই, মানব-কল্পনার পাখা যেখানে অবাধ্য মাধুরী নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ইচ্ছাপুরে !
০৩.
বাংলা লোকসাহিত্যের চারটি মৌলিক উপাদান- প্রবাদ ও প্রবচন, ধাঁধা, ছড়া ও মন্ত্র নিয়ে গবেষক অধ্যাপক ওয়াকিল আহমদ-এর অত্যন্ত পরিশ্রমের ফসল বইপত্র প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত ৭৬৮ পৃষ্ঠার ঢাউস আকারের গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলা লোকসাহিত্যের ধারা’। এটা মূলত তাঁর সংশ্লিষ্ট চারটি গবেষণা গ্রন্থ, যার প্রথম তিনটি প্রথমে বাংলা একাডেমী ও চতুর্থটি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত, এর সামষ্টিক প্রকাশনা বলা যায়। এর প্রথম অংশটির নাম ‘প্রবাদ ও প্রবচন’। এই অংশের ভূমিকায় লেখকের উদ্ধৃতাংশ প্রণিধানযোগ্য।
‘…বাংলাদেশ লোকসাহিত্য অতি সমৃদ্ধ। বাংলার মাটি খুব উর্বর; আবহাওয়া কৃষি-উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। জীবিকার জন্য বাংলার মানুষকে অধিক শ্রম করতে হয় না। এদেশে কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি ও সামন্ত-শাসন দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। ইংরেজ-শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এদেশে প্রকৃত অর্থে নগর গড়ে ওঠেনি। মানুষ গ্রামে-গঞ্জে বসবাস করতো। একটি সীমিত শ্রেণীর মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থাৎ একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে লোকসাহিত্য সৃষ্টির যেসব শর্ত আবশ্যক, বাংলাদেশে সেসব বিদ্যমান ছিল। বাংলার মানুষের ভাষা ছিল, ভাষা প্রকাশের আবেগ, অনুভূতি ছিল। অক্ষর-জ্ঞান না থাকায় মানুষ নিজের সৃষ্টিকে লিপিবদ্ধ করতে পারেনি; মুখের কথা লোকমুখে তুলে দিয়েছে। শ্রুতির আর স্মৃতির উপর নির্ভর করে লোকরচনা এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছে। লোকসাহিত্য এই অর্থেই জনসমষ্টির রচনা। মধ্যযুগের সামন্ত ও ইংরেজ আমলের আধা-সামন্ত সমাজ লোকসাহিত্য সৃষ্টির উপযোগী ক্ষেত্র ছিল বলে আমাদের বিশ্বাস। তবে এ-সৃষ্টির প্রক্রিয়া আজও অব্যাহত আছে।…’
উদ্ধৃতিটি একারণেই প্রণিধানযোগ্য যে, এখান থেকেই খুব সংক্ষেপে আমাদের লোকসাহিত্যের মেজাজ, মর্জি ও সৃষ্টি-রহস্যের একটা ধারণা পেয়ে যাই আমরা। আমাদের লোকায়ত ধারায় ও সার্বজনীন রুচিতে অত্যন্ত সাবলীলভাবে মিশে থাকা বাংলা প্রবাদ ও প্রবচনের খুব শক্তিশালী সুস্পষ্ট প্রভাবটিকে আমরা কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। নিত্যদিনের কর্মকোলাহলে তা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ শুরু করলাম কিনা। আসলে তা নয়। এটা ‘পরের ধনে একটু পোদ্দারি’ করে নেয়া আর কি ! তাছাড়া পোদ্দারিটা পরের ধনেই করতে হয়। নইলে নিজের ধনে অন্য কিছু হলে হতে পারে, কিন্তু পোদ্দারি হয় না। কিভাবে ?
এই যে কথাগুলো বললাম, পাঠক হযতো খেয়াল করেছেন, তা বলতে গিয়ে দুটো বিশেষ বাক্যবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে- ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ ও ‘পরের ধনে পোদ্দারি’। এই ছোট্ট দুটো বাক্যবন্ধের বিকল্প হিসেবে যে দীর্ঘ বর্ণনা বা বিবৃতির প্রয়োজন হতো, তাতে করেও বক্তব্য-বিষয়কে কতোটা স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল করা যেতো তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু আবহমান বাঙালির প্রচলিত কিছু প্রবাদ বা প্রবচনের যথার্থ আশ্রয় ও ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সে সীমাবদ্ধতাটুকু নিমেষেই অতিক্রম করা সহজ হয়ে গেছে। দু-চারটা শব্দের এরকম একেকটা বাক্যবন্ধ হাজারটা শব্দের গাথুনির চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী। এগুলোই প্রবাদ ও প্রবচন। এর শক্তিমত্তা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকেনি বলেই আমাদের আবহমান জীবনধারায় তা লোকমুখে যুগের পর যুগ পেরিয়ে বর্তমানে এসেও এর উপযোগিতা একটুও না হারিয়ে পূর্ণ ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে সতত বহমান রয়েছে। মনের ভাব যথার্থরূপে প্রকাশে মুখের ভাষাকে দিয়েছে সমৃদ্ধি। তবে কথায় কথায় প্রবাদ ও প্রবচনের উল্লেখ টানলেও এ দুটোর মধ্যে যে বিস্তর প্রভেদ রয়ে গেছে, তা হয়তো বেশিরভাগ সময়ই আমরা খেয়াল করি না বা পার্থক্য নির্ণয়ের প্রয়োজনও বোধ করি না। উপরোক্ত যে দুটো বাক্যবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে, তার প্রথমটি ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ হচ্ছে প্রবাদ এবং দ্বিতীয়টি অর্থাৎ ‘পরের ধনে পোদ্দারি’ হচ্ছে প্রবচন।
কেন একটি প্রবাদ আর অন্যটি প্রবচন, এই কৌতুহল নিবৃত্তির প্রয়োজনে আমরা আপাতত গবেষক ওয়াকিল আহমদ-এর পূর্বোক্ত ‘বাংলা লোকসাহিত্যের ধারা’ গবেষণা গ্রন্থের প্রয়োজনীয় সহায়তাটুকু নিতে পারি। ‘প্রবাদ ও প্রবচন’ অংশের বিস্তৃত পরিধির মধ্যে তিনি ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রবাদ ও প্রবচনের শত শত সংগৃহিত নমুনা সংকলন করে এগুলোর আবশ্যকীয় ব্যাখ্যা, বিবেচনা, রূপ ও গঠন-প্রকৃতি নির্ণয় এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে ব্যাপক প্রস্তুতি ও প্রয়াস নিয়েছেন। আমরা নাহয় এর নির্যাসটুকুর দিকেই লক্ষ্য নিবদ্ধ করি।
প্রবাদ নিয়ে ব্যাপক মন্থনের পর তিনি প্রবাদের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করেন এভাবে-
০১. প্রবাদ হলো একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বাক্য।
০২. প্রবাদের উদ্ভবে লোকের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে।
০৩. বাচ্যার্থ নয়, ব্যঞ্জনার্থই প্রবাদের অর্থ। এই অর্থে প্রবাদ রূপকধর্মী রচনা।
০৪. প্রবাদে বুদ্ধির বা চিন্তার ছাপ থাকে।
০৫. সংগীত গান করা হয়, ছড়া আবৃত্তি করা হয়, মন্ত্র বলা হয়, ধাঁধা ধরা হয়, প্রবাদ বাক্যালাপে, বক্তৃতায় অথবা লেখায় প্রসঙ্গক্রমে উচ্চারিত হয়। প্রবাদের স্বাধীন সত্তা আছে, কিন্তু স্বাধীন প্রয়োগ নেই। প্রবাদ বক্তব্যকে তীক্ষ্ণ, যুক্তিকে জোরালো ও প্রকাশকে অর্থবহ করে তোলে।
০৬. প্রবাদের শিকড় ঐতিহ্যে প্রোথিত। ঐতিহ্য থেকে রস সঞ্চয় করে প্রবাদ অর্থপূর্ণ হয় ও ভাষার মধ্যে বহমান থেকে তাকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
অর্থাৎ প্রবাদের অবয়ব ক্ষুদ্র হলেও এর একটি বিষয় আছে, অর্থ আছে। বিষয়টি রূপক-সংকেতের ভাষায় শব্দচিত্রে আরোপিত হয়, আর অর্থ হয় ব্যঞ্জিত। ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ এর নিহিতার্থ হলো, সাধারণ এক কাজ করতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক অন্য বড় বিষয়ের অবতারণা করা বা জড়িয়ে যাওয়া। ‘ধান ভানা’ ও ‘শিবের গীত’ দুটি বিপরীতধর্মী বাক্য দ্বারা এই অর্থ প্রকাশ করা হয়েছে। একইভাবে প্রবাদের আরেকটি উদাহরণ টানা যায়- ‘ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে।’ এর নিহিতার্থ হলো, অন্যের কৃতিত্বকে নিজের কৃতিত্ব বলে জাহির করা।
অন্যদিকে প্রবচন বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনার প্রেক্ষিতে প্রবচনের যে বৈশিষ্ট্যগুলো নির্ধারণ করা হয়, তা হলো-
০১. প্রবচনে জাতির দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার কথা এক বা একাধিক বাক্যে সংহত রূপে প্রকাশিত হয়।
০২. সাধারণ গদ্যে অথবা অন্ত্যমিলযুক্ত ছন্দোবদ্ধ পদ্যে প্রবচন রচিত হয়।
০৩. প্রবচন মূলত বাচ্যার্থনির্ভর; এতে রূপক, প্রতীক, সংকেত, চিত্রকল্পের স্থান নেই।
০৪. প্রবচনের আবেদন প্রত্যক্ষ, সরস ও সহজবোধ্য।
০৫. প্রবাদ অপেক্ষা প্রবচন আকারে-প্রকারে বড় হয়। প্রবাদের অর্থের ধার বেশি, প্রবচনের অর্থের ভার বেশি।
০৬. প্রবচনের বিচিত্র অর্থ ধারণ ও বহন ক্ষমতা আছে। তবে এসব অর্থ একটি কেন্দ্রীয় ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ থাকে।
০৭. প্রবচন রচনায় স্বাধীনতা আছে; এজন্য এতে আবেগ, আনন্দ ও রসের স্থান আছে।
অর্থাৎ প্রবচন বাচ্যার্থনির্ভর; একটি একক বা কেন্দ্রীয় বক্তব্যকে অবলম্বন করে প্রবচন রচিত হয়। অন্ত্যমিল যুক্ত দুটো চরণ নিয়ে প্রধানত প্রবচনের অবয়ব গড়ে উঠে। এতে ছড়ার ছন্দের প্রাধান্য আছে। গদ্যাশ্রিত সরল ও যৌগিক বাক্যের প্রবচনও আছে। ছন্দ, চরণ, অন্ত্যমিল সহযোগে পদ্যের আঙ্গিক পরিলক্ষিত হলেও প্রবচন কবিতা নয়। মূলত শ্রুতিমধুর ও স্মৃতি-সুখকর করার জন্য প্রবচন পদ্যান্বিত হয়ে থাকে। কবিতা-পাঠের আনন্দ প্রবচনে নেই। লেখায়, বক্তৃতায় বা আলোচনায় উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত সময়ে প্রবচন উচ্চারণে আনন্দ নিহিত থাকে। ‘পরের ধনে পোদ্দারি, লোকে বলে লক্ষ্মীশ্বরী।’ এই প্রবচনটিতে কোন ব্যঞ্জনার্থ নিহিত নেই। বরং বাচ্যার্থ বা আরিক অর্থের মধ্যেই প্রবচনের বক্তব্য স্পষ্ট। অন্যের সম্পদ ভোগ-ব্যবহারের মাধ্যমে অহমিকা প্রদর্শনের প্রবণতাকে শ্লেষার্থে এই প্রবচনে সরস উপস্থাপন করা হয়েছে।
গবেষক ওয়াকিল আহমদ সেই চর্যাপদের কাল থেকে ব্যবহৃত প্রবাদ ও প্রবচনের নমুনাসহ আলোচনা করতে গিয়ে এই দুটি ধারার বাইরে আরেকটি ধারা হিসেবে বচন-এর যে মৃদু উল্লেখ করেছেন, তা আলাদাভাবে ব্যাখ্যা বা কোন সুনির্দিষ্ট বিবেচনার প্রয়োজন বোধ করেননি। বরং বচন আর প্রবচনের একাত্মতাই লক্ষ্য করি আমরা। তাঁর সংগৃহিত ও সংকলিত বিপুল সংখ্যক প্রবচনগুলোতে লক্ষ্য করলে জনভাষ্যে চড়ে আসা লোকায়ত ধারার সেইসব প্রবচনগুলোও সংরক্ষিত অবস্থায় দেখতে পাই, যেগুলো ইতোমধ্যে খনার বচন হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে। এবং এখানে এসেই আমাদেরকে আবারো পুরনো প্রশ্নে ফিরে যেতে হয়, তাহলে খনার বচনের প্রকৃত উৎসটা আসলে কোথায় ?
০৪.
‘মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা।’ এই প্রবচনটি উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে লেখাটা শুরু করা হয়েছিলো। এটি পূর্বোক্ত ‘নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা’ প্রকাশনীর ‘খনার বচন’ নামের ক্ষুদ্রাকৃতির বইটিতে মুদ্রিত ০২ ক্রমের উদ্ধৃত বচন। যদিও বইটিতে মুদ্রিত বচনের কোন সংখ্যাক্রম উল্লেখ করা হয়নি, কেবল প্রতি পৃষ্ঠায় একটি করে বচন মুদ্রিত রয়েছে। তবু আলোচনার সুবিধার্থে মুদ্রিত বচনের ধারাবাহিক ক্রমিক অবস্থানকেই ক্রম হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। এই বইয়ে সংকলিত বচনগুলোকে বলা হচ্ছে ‘খনার কৃষি ও ফল সংক্রান্ত বচন’। কিন্তু বচনগুলো যে সত্যিই খনা’র তার কোন উৎসের সন্ধান আমরা বইটি থেকে পাই না।
অন্যদিকে এপ্রিল ২০০৭-এ বইপত্র থেকে প্রকাশিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গবেষক ওয়াকিল আহমদ-এর ‘বাংলা লোকসাহিত্যের ধারা’ গবেষণা গ্রন্থের ‘প্রবাদ ও প্রবচন’ অংশে সংগৃহিত ‘আবহাওয়া ও চাষবাস’ বিষয়ক প্রবচনের ৩৪২ নম্বরে উপরোক্ত প্রবচনটিকেই সংকলিত করা হয়েছে কোন নাম-পরিচয়হীন রচয়িতার লোকায়ত প্রবচন হিসেবে। বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে সংঘটিত অত্যন্ত শ্রমশীল গবেষণাকর্মের কোথাও, যদি কোন ভুল না করে থাকি, খনা নামটি চোখে পড়ে না।
একইভাবে ‘খনার বচন’ বইয়ের ২৪ ক্রমের ‘আমে ধান, তেঁতুলে বান’ বচন ‘বাংলা লোকসাহিত্যের ধারা’ গ্রন্থের ৩৩১ নম্বরে আবহাওয়া ও চাষবাস বিষয়ক লোকায়ত প্রবচন হিসেবে সংকলিত। ৪৫ ক্রমের খনার বচন ‘তিন নাড়ায় সুপারি সোনা,/ তিন নাড়ায় নারিকেল টেনা,/ তিন নাড়ায় শ্রীফল বেল,/ তিন নাড়ায় গেরস্থ গেল।’ ওয়াকিল আহমদ-এর লোকায়ত প্রবচন সংগ্রহে ৩৩৯ নম্বরে সংকলিত। তদ্রূপ ২১ ক্রমের খনার বচন ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ,/ ধন্য রাজা পুণ্য দেশ’ ওয়াকিল আহমদের ৩৪০ নম্বরে এসে একটু আগপর হয়ে সংকলিত হয়েছে ‘ধন্য রাজা পুণ্য দেশ,/ যদি বর্ষে মাঘের শেষ’ হিসেবে। আবার ৩৫ ক্রমের ‘তাল বাড়ে ঝোঁপে, খেজুর বাড়ে কোপে’ খনার বচনটিকে ওয়াকিল আহমদের ৩৩৮ নম্বরে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত রূপে দেখতে পাই- ‘নারিকেল বাড়ে কোপে, তাল বাড়ে ঝোপে’ হিসেবে।
কোথাও কোথাও আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়। যেমন পূর্বোক্ত ‘খনার বচন’ বইয়ের ৩৮ ও ৭০ ক্রমের বচন দুটো হলো- ‘চৈত্রেতে খর খর,/ বৈশাখেতে ঝড় পাথর,/ জ্যৈষ্ঠতে তারা ফুটে,/ তবে জানবে বর্ষা বটে।’ এবং ‘জ্যৈষ্ঠে খরা আষাঢ়ে ভরা,/ শস্যের ভার সহে না ধরা’। ছেটেছুটে এ দুটো বচনেরই একটি সম্মিলিত রূপ আমরা দেখি ওয়াকিল আহমদের সংগৃহিত ‘আবহাওয়া ও চাষবাসভিত্তিক’ ৩৩৭ নম্বর লোকায়ত প্রবচনটিতে- ‘ চৈতে খর খর, বৈশাখে ঝড়-পাথর / জ্যৈষ্ঠে শুখো, আষাঢ়ে ধারা, / শস্যের ভার না সহে ধরা।’ তবে ফেব্রুয়ারি ২০০১-এ ‘গতিধারা’ থেকে প্রকাশিত ওয়াকিল আহমদের অন্য একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘লোককলা প্রবন্ধাবলি’র ‘বৃষ্টি-আবাহন ও বৃষ্টি-বারণ লোকাচার’ অধ্যায়ের এক জায়গায় আমরা খনার বচনের কথা উল্লেখ পাই এভাবে-
“ খনার বচনে আছে কৃষিকাজের বিবিধ রীতি-পদ্ধতি ও নিয়ম-নির্দেশ। হাল, চাষ, বলদ, ভূমি, বীজ, ফলন, বৃষ্টি, বন্যা, শিলা, ঝঞ্ঝা, মাস, ঋতু প্রভৃতি সম্মন্ধে জ্যোতিষী ব্যাখ্যা এগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়। বৃষ্টি ও আবহাওয়া সম্পর্কে রচিত বচনে সাধারণত বৃষ্টি, বন্যা, খরা, সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী থাকে-
চৈত্রেতে খর খর।
বৈশাখেতে ঝড় পাথর।।
জ্যেষ্ঠেতে তার ফুটে।
তবে জানবে বর্ষা বটে।।
অথবা
শনির সাত মঙ্গলের তিন।
আর সব দিন দিন।।
ভাদুরে মেঘ বিপরীত বায়।
সেদিন বৃষ্টি কে ঘোচায়।।
এই বর্ষা বৃষ্টি হলে কৃষক চাষ করবে, বীজ বুনবে, চারা রোপণ করবে, ফসল ফলাবে। বচনগুলো বাংলার ‘কৃষিদর্শন’।”
এখানে উদ্ধৃত বচন দুটোর উৎস সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে- Tamonash Chandra Dasgupta Aspects of Bengali Society, from old Bengali Literature, Calcutta, 1935. p.23 ও পৃ.২৩৩। উল্লেখ্য, প্রথম বচনটি আমাদের পূর্বোক্ত ‘খনার বচন’ বইটির ৩৮ ক্রমে হুবহু উক্ত রয়েছে। তবে দ্বিতীয়টি সেখানে নেই।
হয়তো এভাবে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে এমন আরো প্রচুর নমুনা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হবে না যে, এক জায়গায় যা গবেষকদের শ্রমলব্ধ সংগ্রহে লোকমুখে প্রচারিত নাম-পরিচয়হীন রচয়িতার লোকায়ত প্রবাদ বা প্রবচন হিসেবে সংগৃহিত হয়েছে, অন্যত্র তা-ই খনার বচন হিসেবে সংকলিত হয়ে আছে কোথাও। এই যেমন গবেষক ওয়াকিল আহমদেরই ‘বাংলা লোকসাহিত্যের ধারা’ গবেষণা গ্রন্থের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক লোকায়ত প্রবচন সংগ্রহে ৩১৩, ৩১৭ ও ৩১৯ নম্বর প্রবচনগুলো হচ্ছে- ‘উনা ভাতে দুনা বল,/ অতি ভাতে রসাতল।’, ‘ঘোল, কুল, কলা- তিনে নষ্ট গলা।’ এবং ‘তপ্ত অম্ল, ঠাণ্ডা দুধ, যে খায় সে অদ্ভুত’। এগুলোই পূর্বে উল্লেখিত ‘খনার বচন’ বইয়ে যথাক্রমে ৯৫, ৪৮ ও ৭৭ ক্রমে সংকলিত রয়েছে। যদিও শেষোক্ত দুটো বচনকে সামান্য পরিবর্তিত চেহারায় দেখি আমরা এভাবে- ‘ঘোল, কুল, কলা- তিন নাশে গলা।’ এবং ‘তপ্ত অম্ল ঠাণ্ডা দুধ, যে খায় সে নির্বোধ।’ এখানে ‘নষ্ট’ শব্দের জায়গায় ‘নাশে’ এবং ‘অদ্ভুত’ শব্দের বদলে ‘নির্বোধ’ শব্দের প্রতিস্থাপন ঘটলেও বচন-প্রবচনের ভাব বা অর্থের কোন পরিবর্তন ঘটে নি।
এসব ঘটনা থেকে একটা বিষয় হয়তো আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে থাকে যে, আমাদের লোকসাহিত্যের অত্যন্ত শক্তিশালী ধারা হিসেবে লোকায়ত প্রবাদ-প্রবচন সংগ্রহ ও সংকলনে আমাদের গবেষকরা যতোটা সাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন, খনার বচনের সম্ভাব্যতা নিয়ে বোধ করি ততোটা নিঃসন্দেহ হতে পারেন নি। তবে এ মন্তব্যকে কোনভাবেই মোক্ষম করার দুঃসাহস দেখানো হচ্ছে না এজন্যেই যে, বর্তমান লেখকের অপরিসীম সীমাবদ্ধতা কোনক্রমেই এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার সন্দেহরেখা অতিক্রম করতে পারে নি। তবুও আপাত ধারণা থেকে এরকম প্রশ্নমুখর হওয়াটা হয়তো অসঙ্গত হবে না যে, খনার বচন নামে যে প্রবচনগুলো বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংকলিত হয়েছে বা হচ্ছে, তা কি শুধুই শ্রুতিনির্ভর কোনো কিংবদন্তীয় গল্প-কাহিনী বা রূপকথা আশ্রিত কাল্পনিক আবেগ ? না কি এর পেছনে রয়েছে বিলুপ্ত কোন ইতিহাসনির্ভরতা ? ইতিহাসবেত্তা কোন লোক-গবেষকই তা ভালো বলতে পারবেন। প্রকৃত সত্য কী তা নিরসন না হওয়াতক খনা নামের কোন একক ব্যক্তি বা ব্যক্তিনীর অবস্থিতির বিপরীতে আমাদের সন্দেহের আঙুলটা নাহয় খাড়া হয়েই থাকলো।
০৫.
কিছু কিছু বচনকে সাধারণ জনেরা খুব সহজে এক ডাকেই খনার বচন হিসেবে চিহ্ণিত করে ফেলেন। কেননা বচনগুলোর গঠনরীতির মধ্যেই খনা নামটি উৎকীর্ণ থাকে। যেমন-
(ক)
‘খনা বলে শুন কৃষকগণ/ হাল লয়ে মাঠে বেরুবে যখন/ শুভ দেখে করবে যাত্রা/ না শুনে কানে অশুভ বার্তা।/ ক্ষেতে গিয়ে কর দিক নিরূপণ/ পূর্ব দিক হতে হাল চালন/ নাহিক সংশয় হবে ফলন।’
(খ)
‘খনা বলে শুনে যাও,/ নারিকেল মূলে চিটা দাও।/ গাছ হয় তাজা মোটা,/ তাড়াতাড়ি ধরে গোটা।’
(গ)
‘পূর্ণিমা অমাবস্যায় যে ধরে হাল,/ তার দুঃখ হয় চিরকাল।/ তার বলদের হয় বাত,/ তার ঘরে না থাকে ভাত।/ খনা বলে আমার বাণী,/ যে চষে তার হবে জানি।’
(ঘ)
‘খনা বলে চাষার পো,/ শরতের শেষে সরিষা রো।’
(ঙ)
‘বৎসরের প্রথম ঈষাণে বয়,/ সে বৎসর বর্ষা হবে খনা কয়।’
(চ)
‘উঠান ভরা লাউ শসা,/ খনা বলে লক্ষ্মীর দশা।’
(ছ)
‘খনা ডাকিয়া কন,/ রোদে ধান ছায়ায় পান।’
(জ)
‘ডাক দিয়ে বলে মিহিরের স্ত্রী, শোন পতির পিতা,/ ভাদ্র মাসে জলের মধ্যে নড়েন বসুমাতা।/ রাজ্য নাশে, গো নাশে, হয় অগাধ বান,/ হাটে কাটা গৃহী ফেরে কিনতে না পান ধান।’
(ঝ)
‘ষোল চাষে মূলা, তার অর্ধেক তুলা,/ তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান।/ খনার বচন, মিথ্যা হয় না কদাচন।’
(ঞ)
‘মাঘ মাসে বর্ষে দেবা,/ রাজায় ছাড়ে প্রজার সেবা।/ খনার বাণী,/ মিথ্যা না হয় জানি।’
(ট)
‘ধানের গাছে শামুক পা,/ বন বিড়ালী করে রা।/ গাছে গাছে আগুন জ্বলে,/ বৃষ্টি হবে খনায় বলে।’
(ঠ)
‘কচু বনে ছড়ালে ছাই,/ খনা বলে তার সংখ্যা নাই।’
(ড)
‘যে গুটিকাপাত হয় সাগরের তীরেতে,/ সর্বদা মঙ্গল হয় কহে জ্যোতিষেতে।/ নানা শস্যে পরিপূর্ণ বসুন্ধরা হয়,/ খনা কহে মিহিরকে, নাহিক সংশয়।’
[খনার বচন/ নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা/ ঢাকা/ পঞ্চম সংস্করণ ২০০৭]
বাক্যের গাথুনিতেই যেহেতু খনা শব্দটি জুড়ে দেয়া হয়েছে, ফলে এগুলোকে যে কেউ খনার বচন বলতেই পারেন। তাই বলে এটা প্রমাণসিদ্ধ হয়ে যায় না যে বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় দশম রত্ন হিসেবে একমাত্র খনা নাম্নী কোন বিদূষী জ্যোতিষশাস্ত্রী রমণীর মুখনিঃসৃত বাণী এগুলো। এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবেত্তাদের এদিকে মনোযোগ আকর্ষিত হওয়াটাও জরুরি বৈকি।
মহাকবি বেদব্যাস রচিত এযাবৎ প্রাচীনতম মহাকাব্য মহাভারতের পৌরাণিক চরিত্র শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত উপদেশবাণী হিসেবে শ্রীমদ্ভাগবত গীতা ব্যবহারিক মূল্য বিবেচনায় নির্দিষ্ট একটি ধর্মগোষ্ঠির কাছে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। এখানে ইতিহাসনিষ্ঠতার বদলে ধর্মভীরু একটি জনগোষ্ঠির কিংবদন্তীতুল্য অলৌকিকতায় বিশ্বাসেরই প্রাধান্য দেখতে পাই আমরা। তবে লিপিবদ্ধ ও বহুলচর্চিত সাহিত্য হিসেবে গীতায় যেমন শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণীরূপের এদিক ওদিক বা সংযোজন-বিয়োজনের কোন সুযোগ সাধারণভাবে নেই, লোকায়ত কিংবদন্তীয় চরিত্র খনা’র বিষয়টা মনে হয় ঠিক তার উল্টো হওয়াটাই দারুণভাবে সম্ভব। আর তাই কৃষিসম্পৃক্ত প্রাচীন সমাজে আমাদের বহু অখ্যাত লোক-কবিদের সৃজনশীল মেধায় উপরোক্ত ধরনের এরকম খনার বচন তৈরি হওয়াটা অসম্ভব বা বিচিত্র কিছু নয়। ফলে আমাদেরকে আবারো সেই একই জায়গায় ঘুরপাক খেতে হচ্ছে- খনার বচন আসলে কী ?
লোক-সংস্কৃতির চিরায়ত ধারায় এমন কিছু গীত-রীতির কথা আমরা জানি যা বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে থাকে। যেমন জারি, সারি, ধামাল, গম্ভিরা, ভাওয়াইয়া ইত্যাদি। উদাহরণ হিসেবে রাজশাহী অঞ্চলের গম্ভিরার কথাই ধরি। নাম না জানা বিভিন্ন গীতিকারের নির্দিষ্ট রীতি ও সুরে লেখা গীতের লোকায়ত সমাহার এই গম্ভিরার ধরনে আজকাল অনেক আধুনিক কবি ও গীতিকারের লেখা গানও গম্ভিরার সুরে অনেক শিল্পীরা গেয়ে থাকেন। এগুলোকে আমরা গম্ভিরাই বলে থাকি। রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া বা সিলেট অঞ্চলের ধামাল গানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রচয়িতার নাম জানা থাকলে গীতিকার হিসেবে তাঁর নাম চলে আসে, নইলে বলা হয় সংগৃহিত; অর্থাৎ লোকায়ত উৎস। সেই লোকায়ত উৎসটা যে কোন অচেনা একক রচয়িতাই হবেন তা কিন্তু নয়। খনার বচনের ক্ষেত্রেও এমনটা হওয়া কি অসম্ভব খুব ? খনার বচনকে এরকম সুনির্দিষ্ট একটা প্রবচন রীতি হিসেবে কল্পনা করাটা কি খুব কষ্টকর ?
০৬.
খনার বচন হিসেবে পরিচিত বা পরিবেশিত প্রবচনগুলোর উৎস প্রমাণীত বা অপ্রমাণীত যা-ই হোক, এগুলোর একটা ভাব-রীতি বা ধরণ ইতোমধ্যে চিহ্ণিত হয়ে আছে যে, “খনার বচনে আছে কৃষিকাজের বিবিধ রীতি-পদ্ধতি ও নিয়ম-নির্দেশ। হাল, চাষ, বলদ, ভূমি, বীজ, ফলন, বৃষ্টি, বন্যা, শিলা, ঝঞ্ঝা, মাস, ঋতু প্রভৃতি সম্মন্ধে জ্যোতিষী ব্যাখ্যা এগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়। বৃষ্টি ও আবহাওয়া সম্পর্কে রচিত বচনে সাধারণত বৃষ্টি, বন্যা, খরা, সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী থাকে।… এই বর্ষা বৃষ্টি হলে কৃষক চাষ করবে, বীজ বুনবে, চারা রোপণ করবে, ফসল ফলাবে। বচনগুলো বাংলার ‘কৃষিদর্শন’।” …[পৃ.১৭৫, ওয়াকিল আহমদ/ লোককলা প্রবন্ধাবলি/ গতিধারা, ফেব্রুয়ারি ২০০১]
এ পর্যায়ে এসে তাহলে এ প্রশ্ন আসাটা কি খুব অস্বাভাবিক যে, এই বচনগুলোর নাম আবহাওয়া বা কৃষি বচন না হয়ে খনার বচন হলো কেন ? খনার বচন তো আসলে আবহাওয়া বা কৃষি বচনই। তবু তাকে কেন খনার বচন বলা হয় এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা কি আপাতভাবে কয়েকটি সম্ভাবনা বিবেচনায় নিতে পারি ?
দার্শনিক মিল বলতেন- নাথিং হ্যাপেনস উইদাউট অ্যা কজ। প্রতিটা ঘটনার পেছনেই একটি কারণ রয়েছে। সংঘটিত কোন ঘটনার কার্য-কারণ খোঁজা মানুষের আদিমতম কৌতুহলেরই অংশ। অজানাকে জানা বা জ্ঞানন্বেষণের এই আদিম প্রবণতার ধারাবাহিকতাই মূলত মানুষের চিরায়ত সমকালীনতা। হাজার বছর আগের বা আজকের অবস্থানে মৌলিক কোন তফাৎ নেই, মাত্রাগত ভিন্নতাটুকু ছাড়া। আর এই মাত্রাগত অবস্থাটা হলো মানব প্রজাতি কর্তৃক জাগতিক রহস্য উন্মোচন বা জ্ঞান বিকাশের তুলনামূলক অবস্থান। মানুষের জ্ঞানের জগতে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরার কালের সমকালীনতায় পৌঁছা এবং সেখান থেকে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরার কালের সমকালীনতা পর্যন্ত হেঁটে আসতে মানব সভ্যতার মাত্রাগত অবস্থানের যে তুলনামূলক পরিবর্তন সাধিত হয়ে এসেছে, এরই ধারাবাহিকতায় কত ভাঙাগড়া কত পট পরিবর্তন ঘটে গেছে মানব সভ্যতায়। এগুলোই হয়তো ইতিহাসের নুড়ি-পাথর। এই কার্য-কারণ সম্পর্ক খুঁজতে খুঁজতেই মানুষের বা সভ্যতার এগিয়ে যাওয়া। এক বিশ্বাস থেকে আরেক বিশ্বাসে পদার্পণ, আবার পুরনো অকার্যকর হয়ে ওঠা সে বিশ্বাসকেও ছুঁড়ে ফেলে অন্য কোন আধুনিক বিশ্বাস বা মতবাদ আঁকড়ে নেয়া। তাই জাগতিক ঘটনাবলির কার্য-কারণ খোঁজার ইতিহাসই মূলত মানব সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাস। এসব করতে গিয়ে মানুষ কোন কার্য-কারণ সম্পর্কের যে আপাত ব্যাখ্যা তৈরি করে, সেটা করে তার সমকালীন জ্ঞানের স্তর বা বিন্যাস দিয়ে। সভ্যতা ক্রমশই এগিয়ে যায় বলে একশ’ বছর আগের ব্যাখ্যা আর আজকের ব্যাখ্যা তাই এক থাকে না, থাকতে পারে না।
জগতের যে ঘটনাগুলো মানুষ এড়িয়ে যেতে পারে না, তার কার্য-কারণ সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে সমকালীন আহরিত জ্ঞান দিয়েও যখন পরিপূর্ণভাবে তার রহস্য উন্মোচন করতে ব্যর্থ হয়, তখনই সে আশ্রয় নেয় কল্পনার বা কাল্পনিক ধারণা সৃষ্টির। আর এগুলোকে অদ্ভুতভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে যে সন্তোষজনক যুক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাকে পরিতৃপ্ত করতেই জন্ম নেয় কতকগুলো লোককথা, উপকথা, পুরাণ বা রূপকথার। আমাদের প্রচলিত ধর্মীয় কাহিনীগুলো এই পর্যায়ের বলে জাগতিক ঘটনাবলির কার্য-কারণ সম্পর্কের তৎকালীন ধর্মীয় ব্যাখ্যার সাথে মানব সভ্যতার হেঁটে হেঁটে অনেকদূর এগিয়ে আসা আধুনিক ব্যাখ্যার বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে আজ। এরকমই আরেকটি বিষয় হলো তথাকথিত জ্যোতিষশাস্ত্র।
অজানার প্রতি মানুষের নিরাপত্তাহীনতার ভয় বা সন্দেহ চিরকালের। বিশাল প্রকৃতির মহাজাগতিক ক্ষমতার কাছে নিতান্তই অসহায় মানুষের এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকেই মনোজগতে জন্ম নেয়া শুভ-অশুভ জাতীয় সংস্কারগুলো জাগতিক সকল ক্রিয়াকর্মে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে মানুষকে করে তুলেছে অদৃষ্টবাদী। এই অদৃষ্টবাদিতাই হলো তথাকথিত জ্যোতিষশাস্ত্রের আসল পুঁজি। দৃশ্যমান গ্রহ-নক্ষত্রের আপেক্ষিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক শক্তি তথা আবহাওয়া ও জলবায়ুর মধ্যের আন্ত-সম্পর্কের যে নিয়মতান্ত্রিকতা, দীর্ঘকালীন পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে মানুষের আহরিত জ্ঞানে এ সত্য ধরা পড়েছে খুব স্বাভাবিকভাবেই। আর তাই এই সত্যের সাথে কাল্পনিক শুভ-অশুভের অলৌকিক সংস্কার যুক্ত হয়ে গড়ে ওঠা জ্যোতিষশাস্ত্রই নিয়ন্ত্রণ করেছে এতদঞ্চলের তৎকালীন মানুষের মনোভূমি। এছাড়া কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রকৃতি ও জলবায়ুর সাথে মানুষের সম্পর্ক এমনিতেই গভীর। এই প্রকৃতিনির্ভরতা মানুষকে বরাবরই আকৃষ্ট করেছে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট শুভ অশুভ পরিণতিগুলোর প্রতি। ফলে ‘যদি হয় চৈতে বৃষ্টি, তবে হবে ধানের সৃষ্টি।’ বা ‘আখ, আদা, পুঁই, এই তিনে চৈতি রুই’ জাতীয় কৃষিদর্শনভিত্তিক প্রবচনের সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এবং সাথে ‘সোম ও বুধে না দিও হাত, ধার করিয়া খাইও ভাত’ বা ‘মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা’ জাতীয় শুভ-অশুভ শঙ্কা মিশ্রিত অলৌকিক সংস্কার জাতীয় প্রবচনগুলোও প্রভাব বিস্তার করেছে ধর্মীয় রূপকথার আদলে। কিন্তু একটি নিরক্ষর কৃষিভিত্তিক সমাজে এসব লৌকিক জ্ঞানের ব্যবহারিক শৃঙ্খলা আনয়নে সুনির্দিষ্ট কিছু রীতি মেনে চলায় বাধ্য করার সাবলীল প্রক্রিয়া হলো ধর্মগাথার আদলে কাল্পনিক কোন মনোশাসক সৃষ্টি, যা একাধারে হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য ও আকর্ষণীয়। এরই বহিঃপ্রকাশ হয়তো উপকথার আদলে একজন লীলাবতী বা বিদুষী খনা নামের কিংবদন্তীয় কোন জ্যোতিষশাস্ত্রীর লোককাহিনীর সৃষ্টি ও এর ব্যাপ্তি। যথাযথ সময়ে যে কিনা কৃষিসম্পৃক্ত কোন প্রাজ্ঞ চাষার মুখ দিয়ে বলতে পারে- ‘বাঁশের ধারে হলুদ দিলে,/ খনা বলে দ্বিগুণ বাড়ে।’ কিংবা ‘শুনরে বাপু চাষার বেটা,/ মাটির মধ্যে বেলে যেটা,/ তাতে যদি বুনিস পটল,/ তাতে তোর আশার সফল’ ইত্যাদি। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্যরহিত কোন কাল্পনিক রূপকথা বা কিংবদন্তী নির্ভর ধারণা থেকে চূড়ান্ত কোন অনুসিদ্ধান্ত টানা হয়তো পরিমিত বিবেচনার প্রমাণ রাখে না।
আরেকটি সম্ভাবনা ও যুক্তিকে এক্ষেত্রে বেশ জোরালো মনে হতে পারে। তা হচ্ছে, খনা কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়, প্রবচনের একটি বিশেষ রীতি বা ধারার নাম হলো খনার বচন। আর এই রীতি বা ধারাটি কী, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবু খনা শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করে আমরা এর একটি অনুমান খুঁজে নেয়ার চেষ্ট করতে পারি।
‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ গ্রন্থে ‘খনা’ শব্দের দুটো অর্থ চিহ্ণিত করা হয়েছে। একটি হচ্ছে বিশেষণবাচক- নাকি সুরে কথা বলে এমন। অন্যটি বিশেষ্যবাচক এবং সেই রূপকথা আশ্রিত- বিখ্যাত বাঙালি মহিলা জ্যোতিষী; মিহিরের স্ত্রী। উক্ত অভিধানে খনার বচনের বিশেষ্যবাচক অর্থটি করা হয়েছে এভাবে- জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী চাষাবাদ, বৃক্ষরোপণ, গৃহনির্মাণ প্রভৃতি শুভাশুভ বিষয়ক সুপ্রচলিত প্রবচন যা খনার রচিত বলে প্রসিদ্ধ।
অর্থাৎ খনার বচনের একটি সুনির্দিষ্ট রীতি বা ধরন ইতোমধ্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী চাষাবাদ, বৃক্ষরোপণ, গৃহনির্মাণ, আবহাওয়া, জলবায়ু প্রভৃতি বিষয়সংশ্লিষ্ট শুভাশুভ বিষয়ক সুপ্রচলিত প্রবচনই খনার বচন। এক্ষেত্রে সংশয়ের কোন কারণ দেখি না। সংশয়ের কারণ থেকে যায় শুধু খনা শব্দ বা নামের যৌক্তিক উৎস নিয়েই। সম্ভবত এরও একটি চমৎকার সম্ভাব্যতা যাচাই করে নিতে পারি আমরা।
খনা (খন্ + আ) শব্দের মৌল শব্দ হচ্ছে খন। উল্লেখিত বাংলা অভিধানে এই ‘খন’ শব্দেরও দুটো ভিন্ন কিন্তু পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অর্থ চিহ্ণিত রয়েছে। একটি হলো- ক্ষণ শব্দের কোমল রূপ। আর ‘ক্ষণ’ অর্থ দেয়া আছে ‘মুহূর্ত’। অভিধানে খন শব্দের অন্য অর্থটি মুদ্রিত আছে এভাবে- ভবিষ্যৎ অর্থবোধক (হবে’খন, দেখব’খন)। {‘এখন’ শব্দের ‘এ’ লোপে; স. ক্ষণ}।
উপরোক্ত বিবেচনায় এখন ‘খনা’ শব্দটির ক্রিয়া-বিশেষণবাচক একটি লোকায়তিক অর্থ যদি এভাবে করা হয়, ভবিষ্যতের কোন বিশেষ (শুভাশভ) মুহূর্ত, কোথাও কি ভুল হবে ? যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে ‘খনার বচন’ শব্দযুগলের একটি বাচ্যার্থ দাঁড়ায় এরকম, যে বচনের মধ্য দিয়ে কোন বিষয়ের ভবিষ্যৎ শুভাশুভ মুহূর্ত নির্দেশিত হয় বা হয়েছে, তা-ই খনার বচন। ফলে আরো কিছু প্রশ্নেরও ধারণাগত যৌক্তিক ব্যাখ্যা পেয়ে যেতে পারি আমরা। খনার বচন যে কেবল খনা নামধারী সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিবিশেষেরই রচিত হতে হবে তা নয়। হতে পারে বিজ্ঞ কিছু নিরক্ষর লোক-চাষার। অথবা প্রাচীন কৃষিদর্শন-অভিজ্ঞ কিছু লোক-কবির। বা কৃষিনির্ভর কিছু চতুর ও প্রাজ্ঞ জ্যোতিষীর। তবে এ বচনগুলো যে বিভিন্ন কালের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনের মুখে মুখে ছড়া কাটার মতোই একগুচ্ছ লোকায়ত ভবিষ্যৎ বাণী, তাতে বোধকরি দ্বিমত করার খুব জোরালো অবকাশ থাকবে না। খনার বচনের সবগুলো প্রবচন হয়তো এখনো সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি বা খনার বচনের প্রকৃত সংখ্যাও সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণীত করা সম্ভব নয়। তবু খনার বচনের সেই সব বচন রচয়িতাকে যদি আমরা ‘খনা’ নামেই চিহ্ণিত করি, তাহলে বলতেই হয়, খনা হচ্ছে জনভাষ্যে মিশে থাকা আমাদের একগুচ্ছ লোক-ভাষ্যকার।
‘মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা’ কিংবা ‘কলা রুয়ে না কাটো পাত, তাতেই কাপড় তাতেই ভাত’ অথবা ‘বেঙ ডাকে ঘন ঘন, শীঘ্র হবে বৃষ্টি জান’ বা ‘বামুন বাদল বান, দক্ষিণা পেলেই যান’, এগুলো জনপ্রিয় খনার বচন। কৃষিভিত্তিক জন-মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত এরকম বহু লোক-বচনের সাথেই আমরা পরিচিত। খনার বচনও আছে প্রচুর। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমাদের লোক-সাহিত্যে খনা নামে কেউ কি আদৌ ছিলেন ? আসলে এ প্রশ্নটাও বিভ্রান্তিমূলক। কেননা লোক-সাহিত্য বলতেই আমরা বুঝে নেই যে, লোক-মুখে প্রচলিত সাহিত্য অর্থাৎ জনরুচির সাথে মিশে যাওয়া যে প্রাচীন সাহিত্য বা সাহিত্য-বিশেষের কোন সুনির্দিষ্ট রচয়িতার সন্ধান আমরা পাই না বা জানা নেই তা-ই লোক-সাহিত্য। সাহিত্যে যেহেতু রয়েছে, রচয়িতা আছে তো বটেই। কিন্তু তা লিপিবদ্ধ ছিলো না বলে কাল-চক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া এই রচয়িতারা নাম-পরিচয় হারিয়ে চিহ্ণহীন লোকায়ত পরিচয়ে চিরায়ত জনস্রোতের অংশ হয়ে গেছেন। তাঁদের লিপিহীন মহার্ঘ রচনাগুলো হয়ে গেছে আমাদের সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ, অনেক গবেষক-সংগ্রাহকদের গভীর শ্রমসাধ্য অবদানে কালে কালে সংগৃহীত ও সংরক্ষিত হয়ে যাকে আমরা আজ লোক-সাহিত্য বলে চিহ্ণিত করছি।
লোক-সাহিত্যের এই প্রাথমিক ও অনিবার্য বৈশিষ্ট্য স্বীকার করে নিলে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে এ সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে, খনার বচন বিশুদ্ধ লোক-সাহিত্যের অংশ হতে পারে কি না, নয়তো লোক-সাহিত্যে খনা নামের সুনির্দিষ্ট কোন একক রচয়িতা থাকতে পারে কি না। এক্ষেত্রে যেকোন একটি সম্ভাবনা সত্য হওয়া সম্ভব। পরস্পর-বিরোধী দুটো সম্ভাবনা একইসাথে সত্য হতে পারে না। তাহলে কোনটি সত্য ?
‘খনা’ নামে কেউ থাক বা না থাক, খনা (khona) নাম বা শব্দটি যে আজ কিংবদন্তী, তা নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবেন না। গ্রামে গঞ্জে কৃষি-সম্পৃক্ত আমাদের প্রাচীন প্রবীন গুরুজনেরা এখনো খনা’র কৃষিতত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন কালজয়ী বচনের মাধ্যমে অন্যদেরকে জ্ঞানদান করে থাকেন। জলবায়ু ও প্রকৃতির সাথে কৃষির নিবিড় সম্পর্ক অনস্বীকার্য। এই সম্পর্কগুলো খনার বচনের মধ্য দিয়ে যে অব্যর্থ সূত্রাবদ্ধতা পেয়ে গেছে, তাকে কালোত্তীর্ণের মর্যাদা না দিয়ে উপায় নেই। কিন্তু তাতে করে খনা নামের কোন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিপরিচয় প্রমাণসিদ্ধ হয় না। বর্তমানে সংগৃহীত খনার এই আদি বচনগুলোর এরূপ কোন প্রমাণসিদ্ধ লিপিবদ্ধতা না থাকায় জনভাষ্যের কালপরিক্রমায় সেগুলোর অঞ্চল ও ভাষাভিত্তিক বহু ভ্রংশ-উপভ্রংশ ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়। ফলে এগুলোর আদিরূপ জানার কোন উপায় আর অবশিষ্ট নেই। এছাড়া জনমানুষের মুখে মুখে জনশ্রুত বচনগুলোয় যে কোনো একজন খনার গুটিকয় বচনের সাথে কালে কালে আরো বহু খনার প্রাকৃতিক রচনার সম্মিলন ঘটে নি, তা-ই বা কে বলবে ? বরং কালে কালে কৃষিভিত্তিক সমাজ-সংশ্লিষ্ট বহু জনের বহু অভিজ্ঞতার সমন্বয় সাধনের মধ্য দিয়ে একটা সম্মিলিত মাত্রা পাওয়া এই শ্লোকসদৃশ জমাট রূপটিকেই অধিক যুক্তিসংগত বলে মনে হয়। তাই খনার বচন বলতে আমরা যদি খনা নামের কোন একক ব্যক্তিবিশেষের রচনা না বলে বিভিন্ন কালের বিভিন্ন জনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত জ্ঞানের জমাটবদ্ধ সম্মিলিত রচনা বলে বিবেচনা করি, তা কি খুব অযৌক্তিক হবে ?
০২.
জনভাষ্যের রহস্যময় প্রতিনিধিত্বকারী এই প্রতীকী চরিত্র খনা আসলে কি কোন মিথ-আশ্রয়ী চরিত্র ? ঢাকা ‘নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা’ প্রকাশনী থেকে ২৩ মে ১৯৯৫, ০৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪০২-এ একশ’টি বচনের সমন্বয়ে ‘খনার বচন’ নামে প্রকাশিত হাতের মুঠোয় পুরে ফেলার মতো ক্ষুদ্রাকৃতির বইটির ‘বিদূষী খনা’ শিরোনামে গ্রন্থিত ভূমিকাতূল্য লেখাটিতে কিছু মজার বিষয় লক্ষ্য করা যায়। ‘খনা যে প্রাচীন বাংলাদেশের একজন বিদূষী খ্যাতনাম্নী জ্যোতিষী ছিলেন, সে সম্পর্কে সন্দেহের আর কোন অবকাশ নেই’ বলে সন্দেহমুক্ত করতে নিশ্চয়তাবিধানের যে প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে, তাতে কি আমরা আসলে সন্দেহমুক্ত হতে পারি ? ওখানে আবার বলা হচ্ছে- ‘খনা সম্পর্কে বাংলা ও উড়িয়া ভাষায় কিংবদন্তী আছে। গল্প দুটি প্রায় একরকম কিন্তু একটি মূল জায়গায় মত-পার্থক্য আছে।’ কী সেই মত-পার্থক্য ? তা বুঝতে আমাদেরকে উপরোক্ত বই অনুসরণে কিংবদন্তীয় গল্পটি সম্পর্কে আগে একটা ধারণা নিতে হয়।
কিংবদন্তী:
‘খনা ছিলেন লংকাদ্বীপের রাজকুমারী। লংকাদ্বীপবাসী রাক্ষসগণ একদিন স্ববংশে তাঁর পিতা-মাতাকে হত্যা করে এবং তাঁকে হস্তগত করে। একই সময়ে উজ্জয়িনীর মহারাজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার প্রখ্যাত জ্যোতিষ পণ্ডিত বরাহ তাঁর ভুল গণনায় স্বীয় নবজাত শিশু সন্তান মিহির-এর সহসা অকাল মৃত্যুর কথা জেনে নবজাতককে একটি তাম্র-পাত্রে রেখে স্রোতে ভাসিয়ে দেন। জ্যোতিষ গণনায় তিনি মনে করেছিলেন এভাবে শিশুটি মৃত্যু থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে। পরিত্যক্ত এই শিশুকেও ভাসমান তাম্র-পাত্র থেকে রাক্ষসেরা তুলে নেয় এবং দুটো শিশুকে একসাথে পালন করতে থাকে।
খনা ও মিহির কালক্রমে জ্যোতিষ শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন এবং যৌবনে পরস্পর পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। খনা খগোল শাস্ত্রেও পারদর্শী হয়ে ওঠেন। একদিন খনা ও মিহির গণনায় অবগত হলেন যে, মিহির উজ্জয়নীর সভাপণ্ডিত বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহের পুত্র। এক মাহেন্দ্রক্ষণে উভয়ে রাক্ষস গুরুর অনুমতিক্রমে এবং একজন অনুচরের সহায়তায় পালিয়ে ভারতবর্ষে যাত্রা করেন। উজ্জয়িনীতে এসে খনা ও মিহির পণ্ডিত বরাহের নিকট আত্মপরিচয় দেন। কিন্তু পণ্ডিত সে কথা বিশ্বাস করতে চাইলেন না। কারণ তিনি গণনা দ্বারা জানতে পেরেছিলেন যে, এক বছর বয়সেই তাঁর পুত্র মিহিরের মৃত্যু ঘটবে। খনা তখন তাঁর একটি বচন উদ্ধৃতি দিয়ে শ্বশুরের ভুল গণনা প্রতিপন্ন করেন-
‘কিসের তিথি কিসের বার, জন্ম নক্ষত্র কর সার
কি করো শ্বশুর মতিহীন, পলকে আয়ু বারো দিন।’
অর্থাৎ এ গণনায় মিহিরের আয়ু ১০০ বছর। পণ্ডিত বরাহ সানন্দে খনা ও মিহিরকে স্বগৃহে গ্রহণ করেন। এদিকে পালাবার পর দ্বীপনেতা পলাতক দম্পতিকে ধরার জন্যে আয়োজন করেছিলেন। তখন খনা-মিহিরের ওস্তাদ বলেন যে, ওরা জ্যোতিষী গণনা দ্বারা এমন এক অনুকূল মুহূর্তে পলায়ন করেছেন যে, তারা নিরাপদে পৌঁছে যাবেন। ফলে অনুসন্ধান পরিত্যক্ত হয়।
ক্রমে খনার অগাধ জ্ঞানের কথা জানাজানি হয়ে যায়। রাজসভাতে তিনি আমন্ত্রিত হন। খনার জ্ঞান-গরিমা সভা-পণ্ডিতদের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি তিনি পণ্ডিত বরাহের জ্যোতিষশাস্ত্রীয় বহু দুঃসাধ্য সমস্যা সমাধান করে দিতে লাগলেন। এতে অপমানিত ও ঈর্ষান্বিত পণ্ডিত বরাহ পুত্র-বধুকে জিহ্বা কর্তন করে তাকে বোবা বানিয়ে দেয়ার জন্য পুত্রকে আদেশ করেন। মিহির খনাকে একথা সবিশেষ জানান। খনা এ শাস্তি মেনে নেন। পিতৃ-আদেশে মিহির এক তীক্ষ্ণধার ছুরিকা দ্বারা খনার জিহ্বা কর্তন করেন। মাত্রাধিক রক্তক্ষরণে অসামান্যা বিদূষী খনার মৃত্যু হয়। খনার কর্তিত জিহ্বা ভক্ষণ করে টিকটিকি গুপ্ত জ্ঞান লাভ করে।
উড়িয়া কিংবদন্তী অনুযায়ী খনার আসল নাম ছিল লীলাবতী। শ্বশুর বরাহ তার পুত্র মিহিরকে আদেশ করেছিলেন পুত্রবধুর জিহ্বা কেটে ফেলতে। তাই সে ‘খনা’। আসলে লীলাবতী ও খনা একই ব্যক্তি হতে পারেন। তবে দুটো গল্পেরই সারমর্ম এক: খনার মৃত্যুর কারণ ছিল তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা।
উড়িয়া কিংবদন্তী অনুযায়ী পিতার আদেশ পেয়ে নিরূপায় স্বামী মিহির খনার জিহ্বা কর্তনের পূর্বে কিছু কথা বলার সুযোগ দিয়েছিলেন। খনা তখন কৃষি, আবহ-তত্ত্ব, জ্যোতিষশাস্ত্রীয় এবং মানবজীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বহুবিধ কথা বলে যান। পরবর্তীকালে সে সব কথা ‘বোবার বচন’ বা খনার বচন’ নামে অভিহিত হয়।
খনা সিংহলের রাজকুমারী হলেও বাংলাদেশের সাথে তার সম্পর্ক-সূত্র পাওয়া যায় বিভিন্ন ইতিহাসে। ফলে খনার ভাষা বাংলা হওয়া খুব অবাস্তব নয়। তবে খনার বচনের বর্তমান ভাষা মূল ভাষার বিবর্তিত রূপ। তাঁর আবির্ভাব কাল সম্পর্কে ধারণা করা যায় সম্ভবত তিন চারশ’ বর্ষের মধ্যে হয়েছিল।’
‘খনার বচন’ পুস্তিকার উপরোক্ত রূপকথা জাতীয় গল্প ও একপেশে অনুসিদ্ধান্তটি পড়ে খনা নামের সুনির্দিষ্ট কারো অস্তিত্বের স্বপক্ষে স্পষ্ট ও যৌক্তিক কোন সিদ্ধান্তে আসা কি সম্ভব ?
খনা বিষয়ক অন্য এক কিংবদন্তী অনুসারে তাঁর নিবাস ছিলো পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসাতের দেউলি গ্রামে। পিতার নাম অনাচার্য। চন্দ্রকেতু রাজার আশ্রম চন্দ্রপুরে তিনি বহুকাল বসবাস করেন। কিন্তু কিংবদন্তী তো কিংবদন্তীই, মানব-কল্পনার পাখা যেখানে অবাধ্য মাধুরী নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ইচ্ছাপুরে !
০৩.
বাংলা লোকসাহিত্যের চারটি মৌলিক উপাদান- প্রবাদ ও প্রবচন, ধাঁধা, ছড়া ও মন্ত্র নিয়ে গবেষক অধ্যাপক ওয়াকিল আহমদ-এর অত্যন্ত পরিশ্রমের ফসল বইপত্র প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত ৭৬৮ পৃষ্ঠার ঢাউস আকারের গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলা লোকসাহিত্যের ধারা’। এটা মূলত তাঁর সংশ্লিষ্ট চারটি গবেষণা গ্রন্থ, যার প্রথম তিনটি প্রথমে বাংলা একাডেমী ও চতুর্থটি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত, এর সামষ্টিক প্রকাশনা বলা যায়। এর প্রথম অংশটির নাম ‘প্রবাদ ও প্রবচন’। এই অংশের ভূমিকায় লেখকের উদ্ধৃতাংশ প্রণিধানযোগ্য।
‘…বাংলাদেশ লোকসাহিত্য অতি সমৃদ্ধ। বাংলার মাটি খুব উর্বর; আবহাওয়া কৃষি-উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। জীবিকার জন্য বাংলার মানুষকে অধিক শ্রম করতে হয় না। এদেশে কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি ও সামন্ত-শাসন দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। ইংরেজ-শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এদেশে প্রকৃত অর্থে নগর গড়ে ওঠেনি। মানুষ গ্রামে-গঞ্জে বসবাস করতো। একটি সীমিত শ্রেণীর মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থাৎ একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে লোকসাহিত্য সৃষ্টির যেসব শর্ত আবশ্যক, বাংলাদেশে সেসব বিদ্যমান ছিল। বাংলার মানুষের ভাষা ছিল, ভাষা প্রকাশের আবেগ, অনুভূতি ছিল। অক্ষর-জ্ঞান না থাকায় মানুষ নিজের সৃষ্টিকে লিপিবদ্ধ করতে পারেনি; মুখের কথা লোকমুখে তুলে দিয়েছে। শ্রুতির আর স্মৃতির উপর নির্ভর করে লোকরচনা এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছে। লোকসাহিত্য এই অর্থেই জনসমষ্টির রচনা। মধ্যযুগের সামন্ত ও ইংরেজ আমলের আধা-সামন্ত সমাজ লোকসাহিত্য সৃষ্টির উপযোগী ক্ষেত্র ছিল বলে আমাদের বিশ্বাস। তবে এ-সৃষ্টির প্রক্রিয়া আজও অব্যাহত আছে।…’
উদ্ধৃতিটি একারণেই প্রণিধানযোগ্য যে, এখান থেকেই খুব সংক্ষেপে আমাদের লোকসাহিত্যের মেজাজ, মর্জি ও সৃষ্টি-রহস্যের একটা ধারণা পেয়ে যাই আমরা। আমাদের লোকায়ত ধারায় ও সার্বজনীন রুচিতে অত্যন্ত সাবলীলভাবে মিশে থাকা বাংলা প্রবাদ ও প্রবচনের খুব শক্তিশালী সুস্পষ্ট প্রভাবটিকে আমরা কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারি না। নিত্যদিনের কর্মকোলাহলে তা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ শুরু করলাম কিনা। আসলে তা নয়। এটা ‘পরের ধনে একটু পোদ্দারি’ করে নেয়া আর কি ! তাছাড়া পোদ্দারিটা পরের ধনেই করতে হয়। নইলে নিজের ধনে অন্য কিছু হলে হতে পারে, কিন্তু পোদ্দারি হয় না। কিভাবে ?
এই যে কথাগুলো বললাম, পাঠক হযতো খেয়াল করেছেন, তা বলতে গিয়ে দুটো বিশেষ বাক্যবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে- ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ ও ‘পরের ধনে পোদ্দারি’। এই ছোট্ট দুটো বাক্যবন্ধের বিকল্প হিসেবে যে দীর্ঘ বর্ণনা বা বিবৃতির প্রয়োজন হতো, তাতে করেও বক্তব্য-বিষয়কে কতোটা স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল করা যেতো তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু আবহমান বাঙালির প্রচলিত কিছু প্রবাদ বা প্রবচনের যথার্থ আশ্রয় ও ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সে সীমাবদ্ধতাটুকু নিমেষেই অতিক্রম করা সহজ হয়ে গেছে। দু-চারটা শব্দের এরকম একেকটা বাক্যবন্ধ হাজারটা শব্দের গাথুনির চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী। এগুলোই প্রবাদ ও প্রবচন। এর শক্তিমত্তা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকেনি বলেই আমাদের আবহমান জীবনধারায় তা লোকমুখে যুগের পর যুগ পেরিয়ে বর্তমানে এসেও এর উপযোগিতা একটুও না হারিয়ে পূর্ণ ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে সতত বহমান রয়েছে। মনের ভাব যথার্থরূপে প্রকাশে মুখের ভাষাকে দিয়েছে সমৃদ্ধি। তবে কথায় কথায় প্রবাদ ও প্রবচনের উল্লেখ টানলেও এ দুটোর মধ্যে যে বিস্তর প্রভেদ রয়ে গেছে, তা হয়তো বেশিরভাগ সময়ই আমরা খেয়াল করি না বা পার্থক্য নির্ণয়ের প্রয়োজনও বোধ করি না। উপরোক্ত যে দুটো বাক্যবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে, তার প্রথমটি ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ হচ্ছে প্রবাদ এবং দ্বিতীয়টি অর্থাৎ ‘পরের ধনে পোদ্দারি’ হচ্ছে প্রবচন।
কেন একটি প্রবাদ আর অন্যটি প্রবচন, এই কৌতুহল নিবৃত্তির প্রয়োজনে আমরা আপাতত গবেষক ওয়াকিল আহমদ-এর পূর্বোক্ত ‘বাংলা লোকসাহিত্যের ধারা’ গবেষণা গ্রন্থের প্রয়োজনীয় সহায়তাটুকু নিতে পারি। ‘প্রবাদ ও প্রবচন’ অংশের বিস্তৃত পরিধির মধ্যে তিনি ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রবাদ ও প্রবচনের শত শত সংগৃহিত নমুনা সংকলন করে এগুলোর আবশ্যকীয় ব্যাখ্যা, বিবেচনা, রূপ ও গঠন-প্রকৃতি নির্ণয় এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে ব্যাপক প্রস্তুতি ও প্রয়াস নিয়েছেন। আমরা নাহয় এর নির্যাসটুকুর দিকেই লক্ষ্য নিবদ্ধ করি।
প্রবাদ নিয়ে ব্যাপক মন্থনের পর তিনি প্রবাদের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করেন এভাবে-
০১. প্রবাদ হলো একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বাক্য।
০২. প্রবাদের উদ্ভবে লোকের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে।
০৩. বাচ্যার্থ নয়, ব্যঞ্জনার্থই প্রবাদের অর্থ। এই অর্থে প্রবাদ রূপকধর্মী রচনা।
০৪. প্রবাদে বুদ্ধির বা চিন্তার ছাপ থাকে।
০৫. সংগীত গান করা হয়, ছড়া আবৃত্তি করা হয়, মন্ত্র বলা হয়, ধাঁধা ধরা হয়, প্রবাদ বাক্যালাপে, বক্তৃতায় অথবা লেখায় প্রসঙ্গক্রমে উচ্চারিত হয়। প্রবাদের স্বাধীন সত্তা আছে, কিন্তু স্বাধীন প্রয়োগ নেই। প্রবাদ বক্তব্যকে তীক্ষ্ণ, যুক্তিকে জোরালো ও প্রকাশকে অর্থবহ করে তোলে।
০৬. প্রবাদের শিকড় ঐতিহ্যে প্রোথিত। ঐতিহ্য থেকে রস সঞ্চয় করে প্রবাদ অর্থপূর্ণ হয় ও ভাষার মধ্যে বহমান থেকে তাকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
অর্থাৎ প্রবাদের অবয়ব ক্ষুদ্র হলেও এর একটি বিষয় আছে, অর্থ আছে। বিষয়টি রূপক-সংকেতের ভাষায় শব্দচিত্রে আরোপিত হয়, আর অর্থ হয় ব্যঞ্জিত। ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ এর নিহিতার্থ হলো, সাধারণ এক কাজ করতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক অন্য বড় বিষয়ের অবতারণা করা বা জড়িয়ে যাওয়া। ‘ধান ভানা’ ও ‘শিবের গীত’ দুটি বিপরীতধর্মী বাক্য দ্বারা এই অর্থ প্রকাশ করা হয়েছে। একইভাবে প্রবাদের আরেকটি উদাহরণ টানা যায়- ‘ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে।’ এর নিহিতার্থ হলো, অন্যের কৃতিত্বকে নিজের কৃতিত্ব বলে জাহির করা।
অন্যদিকে প্রবচন বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনার প্রেক্ষিতে প্রবচনের যে বৈশিষ্ট্যগুলো নির্ধারণ করা হয়, তা হলো-
০১. প্রবচনে জাতির দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার কথা এক বা একাধিক বাক্যে সংহত রূপে প্রকাশিত হয়।
০২. সাধারণ গদ্যে অথবা অন্ত্যমিলযুক্ত ছন্দোবদ্ধ পদ্যে প্রবচন রচিত হয়।
০৩. প্রবচন মূলত বাচ্যার্থনির্ভর; এতে রূপক, প্রতীক, সংকেত, চিত্রকল্পের স্থান নেই।
০৪. প্রবচনের আবেদন প্রত্যক্ষ, সরস ও সহজবোধ্য।
০৫. প্রবাদ অপেক্ষা প্রবচন আকারে-প্রকারে বড় হয়। প্রবাদের অর্থের ধার বেশি, প্রবচনের অর্থের ভার বেশি।
০৬. প্রবচনের বিচিত্র অর্থ ধারণ ও বহন ক্ষমতা আছে। তবে এসব অর্থ একটি কেন্দ্রীয় ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ থাকে।
০৭. প্রবচন রচনায় স্বাধীনতা আছে; এজন্য এতে আবেগ, আনন্দ ও রসের স্থান আছে।
অর্থাৎ প্রবচন বাচ্যার্থনির্ভর; একটি একক বা কেন্দ্রীয় বক্তব্যকে অবলম্বন করে প্রবচন রচিত হয়। অন্ত্যমিল যুক্ত দুটো চরণ নিয়ে প্রধানত প্রবচনের অবয়ব গড়ে উঠে। এতে ছড়ার ছন্দের প্রাধান্য আছে। গদ্যাশ্রিত সরল ও যৌগিক বাক্যের প্রবচনও আছে। ছন্দ, চরণ, অন্ত্যমিল সহযোগে পদ্যের আঙ্গিক পরিলক্ষিত হলেও প্রবচন কবিতা নয়। মূলত শ্রুতিমধুর ও স্মৃতি-সুখকর করার জন্য প্রবচন পদ্যান্বিত হয়ে থাকে। কবিতা-পাঠের আনন্দ প্রবচনে নেই। লেখায়, বক্তৃতায় বা আলোচনায় উপযুক্ত স্থানে উপযুক্ত সময়ে প্রবচন উচ্চারণে আনন্দ নিহিত থাকে। ‘পরের ধনে পোদ্দারি, লোকে বলে লক্ষ্মীশ্বরী।’ এই প্রবচনটিতে কোন ব্যঞ্জনার্থ নিহিত নেই। বরং বাচ্যার্থ বা আরিক অর্থের মধ্যেই প্রবচনের বক্তব্য স্পষ্ট। অন্যের সম্পদ ভোগ-ব্যবহারের মাধ্যমে অহমিকা প্রদর্শনের প্রবণতাকে শ্লেষার্থে এই প্রবচনে সরস উপস্থাপন করা হয়েছে।
গবেষক ওয়াকিল আহমদ সেই চর্যাপদের কাল থেকে ব্যবহৃত প্রবাদ ও প্রবচনের নমুনাসহ আলোচনা করতে গিয়ে এই দুটি ধারার বাইরে আরেকটি ধারা হিসেবে বচন-এর যে মৃদু উল্লেখ করেছেন, তা আলাদাভাবে ব্যাখ্যা বা কোন সুনির্দিষ্ট বিবেচনার প্রয়োজন বোধ করেননি। বরং বচন আর প্রবচনের একাত্মতাই লক্ষ্য করি আমরা। তাঁর সংগৃহিত ও সংকলিত বিপুল সংখ্যক প্রবচনগুলোতে লক্ষ্য করলে জনভাষ্যে চড়ে আসা লোকায়ত ধারার সেইসব প্রবচনগুলোও সংরক্ষিত অবস্থায় দেখতে পাই, যেগুলো ইতোমধ্যে খনার বচন হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে। এবং এখানে এসেই আমাদেরকে আবারো পুরনো প্রশ্নে ফিরে যেতে হয়, তাহলে খনার বচনের প্রকৃত উৎসটা আসলে কোথায় ?
০৪.
‘মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা।’ এই প্রবচনটি উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে লেখাটা শুরু করা হয়েছিলো। এটি পূর্বোক্ত ‘নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা’ প্রকাশনীর ‘খনার বচন’ নামের ক্ষুদ্রাকৃতির বইটিতে মুদ্রিত ০২ ক্রমের উদ্ধৃত বচন। যদিও বইটিতে মুদ্রিত বচনের কোন সংখ্যাক্রম উল্লেখ করা হয়নি, কেবল প্রতি পৃষ্ঠায় একটি করে বচন মুদ্রিত রয়েছে। তবু আলোচনার সুবিধার্থে মুদ্রিত বচনের ধারাবাহিক ক্রমিক অবস্থানকেই ক্রম হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। এই বইয়ে সংকলিত বচনগুলোকে বলা হচ্ছে ‘খনার কৃষি ও ফল সংক্রান্ত বচন’। কিন্তু বচনগুলো যে সত্যিই খনা’র তার কোন উৎসের সন্ধান আমরা বইটি থেকে পাই না।
অন্যদিকে এপ্রিল ২০০৭-এ বইপত্র থেকে প্রকাশিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গবেষক ওয়াকিল আহমদ-এর ‘বাংলা লোকসাহিত্যের ধারা’ গবেষণা গ্রন্থের ‘প্রবাদ ও প্রবচন’ অংশে সংগৃহিত ‘আবহাওয়া ও চাষবাস’ বিষয়ক প্রবচনের ৩৪২ নম্বরে উপরোক্ত প্রবচনটিকেই সংকলিত করা হয়েছে কোন নাম-পরিচয়হীন রচয়িতার লোকায়ত প্রবচন হিসেবে। বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে সংঘটিত অত্যন্ত শ্রমশীল গবেষণাকর্মের কোথাও, যদি কোন ভুল না করে থাকি, খনা নামটি চোখে পড়ে না।
একইভাবে ‘খনার বচন’ বইয়ের ২৪ ক্রমের ‘আমে ধান, তেঁতুলে বান’ বচন ‘বাংলা লোকসাহিত্যের ধারা’ গ্রন্থের ৩৩১ নম্বরে আবহাওয়া ও চাষবাস বিষয়ক লোকায়ত প্রবচন হিসেবে সংকলিত। ৪৫ ক্রমের খনার বচন ‘তিন নাড়ায় সুপারি সোনা,/ তিন নাড়ায় নারিকেল টেনা,/ তিন নাড়ায় শ্রীফল বেল,/ তিন নাড়ায় গেরস্থ গেল।’ ওয়াকিল আহমদ-এর লোকায়ত প্রবচন সংগ্রহে ৩৩৯ নম্বরে সংকলিত। তদ্রূপ ২১ ক্রমের খনার বচন ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ,/ ধন্য রাজা পুণ্য দেশ’ ওয়াকিল আহমদের ৩৪০ নম্বরে এসে একটু আগপর হয়ে সংকলিত হয়েছে ‘ধন্য রাজা পুণ্য দেশ,/ যদি বর্ষে মাঘের শেষ’ হিসেবে। আবার ৩৫ ক্রমের ‘তাল বাড়ে ঝোঁপে, খেজুর বাড়ে কোপে’ খনার বচনটিকে ওয়াকিল আহমদের ৩৩৮ নম্বরে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত রূপে দেখতে পাই- ‘নারিকেল বাড়ে কোপে, তাল বাড়ে ঝোপে’ হিসেবে।
কোথাও কোথাও আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়। যেমন পূর্বোক্ত ‘খনার বচন’ বইয়ের ৩৮ ও ৭০ ক্রমের বচন দুটো হলো- ‘চৈত্রেতে খর খর,/ বৈশাখেতে ঝড় পাথর,/ জ্যৈষ্ঠতে তারা ফুটে,/ তবে জানবে বর্ষা বটে।’ এবং ‘জ্যৈষ্ঠে খরা আষাঢ়ে ভরা,/ শস্যের ভার সহে না ধরা’। ছেটেছুটে এ দুটো বচনেরই একটি সম্মিলিত রূপ আমরা দেখি ওয়াকিল আহমদের সংগৃহিত ‘আবহাওয়া ও চাষবাসভিত্তিক’ ৩৩৭ নম্বর লোকায়ত প্রবচনটিতে- ‘ চৈতে খর খর, বৈশাখে ঝড়-পাথর / জ্যৈষ্ঠে শুখো, আষাঢ়ে ধারা, / শস্যের ভার না সহে ধরা।’ তবে ফেব্রুয়ারি ২০০১-এ ‘গতিধারা’ থেকে প্রকাশিত ওয়াকিল আহমদের অন্য একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘লোককলা প্রবন্ধাবলি’র ‘বৃষ্টি-আবাহন ও বৃষ্টি-বারণ লোকাচার’ অধ্যায়ের এক জায়গায় আমরা খনার বচনের কথা উল্লেখ পাই এভাবে-
“ খনার বচনে আছে কৃষিকাজের বিবিধ রীতি-পদ্ধতি ও নিয়ম-নির্দেশ। হাল, চাষ, বলদ, ভূমি, বীজ, ফলন, বৃষ্টি, বন্যা, শিলা, ঝঞ্ঝা, মাস, ঋতু প্রভৃতি সম্মন্ধে জ্যোতিষী ব্যাখ্যা এগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়। বৃষ্টি ও আবহাওয়া সম্পর্কে রচিত বচনে সাধারণত বৃষ্টি, বন্যা, খরা, সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী থাকে-
চৈত্রেতে খর খর।
বৈশাখেতে ঝড় পাথর।।
জ্যেষ্ঠেতে তার ফুটে।
তবে জানবে বর্ষা বটে।।
অথবা
শনির সাত মঙ্গলের তিন।
আর সব দিন দিন।।
ভাদুরে মেঘ বিপরীত বায়।
সেদিন বৃষ্টি কে ঘোচায়।।
এই বর্ষা বৃষ্টি হলে কৃষক চাষ করবে, বীজ বুনবে, চারা রোপণ করবে, ফসল ফলাবে। বচনগুলো বাংলার ‘কৃষিদর্শন’।”
এখানে উদ্ধৃত বচন দুটোর উৎস সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে- Tamonash Chandra Dasgupta Aspects of Bengali Society, from old Bengali Literature, Calcutta, 1935. p.23 ও পৃ.২৩৩। উল্লেখ্য, প্রথম বচনটি আমাদের পূর্বোক্ত ‘খনার বচন’ বইটির ৩৮ ক্রমে হুবহু উক্ত রয়েছে। তবে দ্বিতীয়টি সেখানে নেই।
হয়তো এভাবে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে এমন আরো প্রচুর নমুনা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হবে না যে, এক জায়গায় যা গবেষকদের শ্রমলব্ধ সংগ্রহে লোকমুখে প্রচারিত নাম-পরিচয়হীন রচয়িতার লোকায়ত প্রবাদ বা প্রবচন হিসেবে সংগৃহিত হয়েছে, অন্যত্র তা-ই খনার বচন হিসেবে সংকলিত হয়ে আছে কোথাও। এই যেমন গবেষক ওয়াকিল আহমদেরই ‘বাংলা লোকসাহিত্যের ধারা’ গবেষণা গ্রন্থের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক লোকায়ত প্রবচন সংগ্রহে ৩১৩, ৩১৭ ও ৩১৯ নম্বর প্রবচনগুলো হচ্ছে- ‘উনা ভাতে দুনা বল,/ অতি ভাতে রসাতল।’, ‘ঘোল, কুল, কলা- তিনে নষ্ট গলা।’ এবং ‘তপ্ত অম্ল, ঠাণ্ডা দুধ, যে খায় সে অদ্ভুত’। এগুলোই পূর্বে উল্লেখিত ‘খনার বচন’ বইয়ে যথাক্রমে ৯৫, ৪৮ ও ৭৭ ক্রমে সংকলিত রয়েছে। যদিও শেষোক্ত দুটো বচনকে সামান্য পরিবর্তিত চেহারায় দেখি আমরা এভাবে- ‘ঘোল, কুল, কলা- তিন নাশে গলা।’ এবং ‘তপ্ত অম্ল ঠাণ্ডা দুধ, যে খায় সে নির্বোধ।’ এখানে ‘নষ্ট’ শব্দের জায়গায় ‘নাশে’ এবং ‘অদ্ভুত’ শব্দের বদলে ‘নির্বোধ’ শব্দের প্রতিস্থাপন ঘটলেও বচন-প্রবচনের ভাব বা অর্থের কোন পরিবর্তন ঘটে নি।
এসব ঘটনা থেকে একটা বিষয় হয়তো আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে থাকে যে, আমাদের লোকসাহিত্যের অত্যন্ত শক্তিশালী ধারা হিসেবে লোকায়ত প্রবাদ-প্রবচন সংগ্রহ ও সংকলনে আমাদের গবেষকরা যতোটা সাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন, খনার বচনের সম্ভাব্যতা নিয়ে বোধ করি ততোটা নিঃসন্দেহ হতে পারেন নি। তবে এ মন্তব্যকে কোনভাবেই মোক্ষম করার দুঃসাহস দেখানো হচ্ছে না এজন্যেই যে, বর্তমান লেখকের অপরিসীম সীমাবদ্ধতা কোনক্রমেই এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার সন্দেহরেখা অতিক্রম করতে পারে নি। তবুও আপাত ধারণা থেকে এরকম প্রশ্নমুখর হওয়াটা হয়তো অসঙ্গত হবে না যে, খনার বচন নামে যে প্রবচনগুলো বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংকলিত হয়েছে বা হচ্ছে, তা কি শুধুই শ্রুতিনির্ভর কোনো কিংবদন্তীয় গল্প-কাহিনী বা রূপকথা আশ্রিত কাল্পনিক আবেগ ? না কি এর পেছনে রয়েছে বিলুপ্ত কোন ইতিহাসনির্ভরতা ? ইতিহাসবেত্তা কোন লোক-গবেষকই তা ভালো বলতে পারবেন। প্রকৃত সত্য কী তা নিরসন না হওয়াতক খনা নামের কোন একক ব্যক্তি বা ব্যক্তিনীর অবস্থিতির বিপরীতে আমাদের সন্দেহের আঙুলটা নাহয় খাড়া হয়েই থাকলো।
০৫.
কিছু কিছু বচনকে সাধারণ জনেরা খুব সহজে এক ডাকেই খনার বচন হিসেবে চিহ্ণিত করে ফেলেন। কেননা বচনগুলোর গঠনরীতির মধ্যেই খনা নামটি উৎকীর্ণ থাকে। যেমন-
(ক)
‘খনা বলে শুন কৃষকগণ/ হাল লয়ে মাঠে বেরুবে যখন/ শুভ দেখে করবে যাত্রা/ না শুনে কানে অশুভ বার্তা।/ ক্ষেতে গিয়ে কর দিক নিরূপণ/ পূর্ব দিক হতে হাল চালন/ নাহিক সংশয় হবে ফলন।’
(খ)
‘খনা বলে শুনে যাও,/ নারিকেল মূলে চিটা দাও।/ গাছ হয় তাজা মোটা,/ তাড়াতাড়ি ধরে গোটা।’
(গ)
‘পূর্ণিমা অমাবস্যায় যে ধরে হাল,/ তার দুঃখ হয় চিরকাল।/ তার বলদের হয় বাত,/ তার ঘরে না থাকে ভাত।/ খনা বলে আমার বাণী,/ যে চষে তার হবে জানি।’
(ঘ)
‘খনা বলে চাষার পো,/ শরতের শেষে সরিষা রো।’
(ঙ)
‘বৎসরের প্রথম ঈষাণে বয়,/ সে বৎসর বর্ষা হবে খনা কয়।’
(চ)
‘উঠান ভরা লাউ শসা,/ খনা বলে লক্ষ্মীর দশা।’
(ছ)
‘খনা ডাকিয়া কন,/ রোদে ধান ছায়ায় পান।’
(জ)
‘ডাক দিয়ে বলে মিহিরের স্ত্রী, শোন পতির পিতা,/ ভাদ্র মাসে জলের মধ্যে নড়েন বসুমাতা।/ রাজ্য নাশে, গো নাশে, হয় অগাধ বান,/ হাটে কাটা গৃহী ফেরে কিনতে না পান ধান।’
(ঝ)
‘ষোল চাষে মূলা, তার অর্ধেক তুলা,/ তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান।/ খনার বচন, মিথ্যা হয় না কদাচন।’
(ঞ)
‘মাঘ মাসে বর্ষে দেবা,/ রাজায় ছাড়ে প্রজার সেবা।/ খনার বাণী,/ মিথ্যা না হয় জানি।’
(ট)
‘ধানের গাছে শামুক পা,/ বন বিড়ালী করে রা।/ গাছে গাছে আগুন জ্বলে,/ বৃষ্টি হবে খনায় বলে।’
(ঠ)
‘কচু বনে ছড়ালে ছাই,/ খনা বলে তার সংখ্যা নাই।’
(ড)
‘যে গুটিকাপাত হয় সাগরের তীরেতে,/ সর্বদা মঙ্গল হয় কহে জ্যোতিষেতে।/ নানা শস্যে পরিপূর্ণ বসুন্ধরা হয়,/ খনা কহে মিহিরকে, নাহিক সংশয়।’
[খনার বচন/ নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা/ ঢাকা/ পঞ্চম সংস্করণ ২০০৭]
বাক্যের গাথুনিতেই যেহেতু খনা শব্দটি জুড়ে দেয়া হয়েছে, ফলে এগুলোকে যে কেউ খনার বচন বলতেই পারেন। তাই বলে এটা প্রমাণসিদ্ধ হয়ে যায় না যে বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় দশম রত্ন হিসেবে একমাত্র খনা নাম্নী কোন বিদূষী জ্যোতিষশাস্ত্রী রমণীর মুখনিঃসৃত বাণী এগুলো। এক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবেত্তাদের এদিকে মনোযোগ আকর্ষিত হওয়াটাও জরুরি বৈকি।
মহাকবি বেদব্যাস রচিত এযাবৎ প্রাচীনতম মহাকাব্য মহাভারতের পৌরাণিক চরিত্র শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত উপদেশবাণী হিসেবে শ্রীমদ্ভাগবত গীতা ব্যবহারিক মূল্য বিবেচনায় নির্দিষ্ট একটি ধর্মগোষ্ঠির কাছে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। এখানে ইতিহাসনিষ্ঠতার বদলে ধর্মভীরু একটি জনগোষ্ঠির কিংবদন্তীতুল্য অলৌকিকতায় বিশ্বাসেরই প্রাধান্য দেখতে পাই আমরা। তবে লিপিবদ্ধ ও বহুলচর্চিত সাহিত্য হিসেবে গীতায় যেমন শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণীরূপের এদিক ওদিক বা সংযোজন-বিয়োজনের কোন সুযোগ সাধারণভাবে নেই, লোকায়ত কিংবদন্তীয় চরিত্র খনা’র বিষয়টা মনে হয় ঠিক তার উল্টো হওয়াটাই দারুণভাবে সম্ভব। আর তাই কৃষিসম্পৃক্ত প্রাচীন সমাজে আমাদের বহু অখ্যাত লোক-কবিদের সৃজনশীল মেধায় উপরোক্ত ধরনের এরকম খনার বচন তৈরি হওয়াটা অসম্ভব বা বিচিত্র কিছু নয়। ফলে আমাদেরকে আবারো সেই একই জায়গায় ঘুরপাক খেতে হচ্ছে- খনার বচন আসলে কী ?
লোক-সংস্কৃতির চিরায়ত ধারায় এমন কিছু গীত-রীতির কথা আমরা জানি যা বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে থাকে। যেমন জারি, সারি, ধামাল, গম্ভিরা, ভাওয়াইয়া ইত্যাদি। উদাহরণ হিসেবে রাজশাহী অঞ্চলের গম্ভিরার কথাই ধরি। নাম না জানা বিভিন্ন গীতিকারের নির্দিষ্ট রীতি ও সুরে লেখা গীতের লোকায়ত সমাহার এই গম্ভিরার ধরনে আজকাল অনেক আধুনিক কবি ও গীতিকারের লেখা গানও গম্ভিরার সুরে অনেক শিল্পীরা গেয়ে থাকেন। এগুলোকে আমরা গম্ভিরাই বলে থাকি। রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া বা সিলেট অঞ্চলের ধামাল গানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রচয়িতার নাম জানা থাকলে গীতিকার হিসেবে তাঁর নাম চলে আসে, নইলে বলা হয় সংগৃহিত; অর্থাৎ লোকায়ত উৎস। সেই লোকায়ত উৎসটা যে কোন অচেনা একক রচয়িতাই হবেন তা কিন্তু নয়। খনার বচনের ক্ষেত্রেও এমনটা হওয়া কি অসম্ভব খুব ? খনার বচনকে এরকম সুনির্দিষ্ট একটা প্রবচন রীতি হিসেবে কল্পনা করাটা কি খুব কষ্টকর ?
০৬.
খনার বচন হিসেবে পরিচিত বা পরিবেশিত প্রবচনগুলোর উৎস প্রমাণীত বা অপ্রমাণীত যা-ই হোক, এগুলোর একটা ভাব-রীতি বা ধরণ ইতোমধ্যে চিহ্ণিত হয়ে আছে যে, “খনার বচনে আছে কৃষিকাজের বিবিধ রীতি-পদ্ধতি ও নিয়ম-নির্দেশ। হাল, চাষ, বলদ, ভূমি, বীজ, ফলন, বৃষ্টি, বন্যা, শিলা, ঝঞ্ঝা, মাস, ঋতু প্রভৃতি সম্মন্ধে জ্যোতিষী ব্যাখ্যা এগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়। বৃষ্টি ও আবহাওয়া সম্পর্কে রচিত বচনে সাধারণত বৃষ্টি, বন্যা, খরা, সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী থাকে।… এই বর্ষা বৃষ্টি হলে কৃষক চাষ করবে, বীজ বুনবে, চারা রোপণ করবে, ফসল ফলাবে। বচনগুলো বাংলার ‘কৃষিদর্শন’।” …[পৃ.১৭৫, ওয়াকিল আহমদ/ লোককলা প্রবন্ধাবলি/ গতিধারা, ফেব্রুয়ারি ২০০১]
এ পর্যায়ে এসে তাহলে এ প্রশ্ন আসাটা কি খুব অস্বাভাবিক যে, এই বচনগুলোর নাম আবহাওয়া বা কৃষি বচন না হয়ে খনার বচন হলো কেন ? খনার বচন তো আসলে আবহাওয়া বা কৃষি বচনই। তবু তাকে কেন খনার বচন বলা হয় এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা কি আপাতভাবে কয়েকটি সম্ভাবনা বিবেচনায় নিতে পারি ?
দার্শনিক মিল বলতেন- নাথিং হ্যাপেনস উইদাউট অ্যা কজ। প্রতিটা ঘটনার পেছনেই একটি কারণ রয়েছে। সংঘটিত কোন ঘটনার কার্য-কারণ খোঁজা মানুষের আদিমতম কৌতুহলেরই অংশ। অজানাকে জানা বা জ্ঞানন্বেষণের এই আদিম প্রবণতার ধারাবাহিকতাই মূলত মানুষের চিরায়ত সমকালীনতা। হাজার বছর আগের বা আজকের অবস্থানে মৌলিক কোন তফাৎ নেই, মাত্রাগত ভিন্নতাটুকু ছাড়া। আর এই মাত্রাগত অবস্থাটা হলো মানব প্রজাতি কর্তৃক জাগতিক রহস্য উন্মোচন বা জ্ঞান বিকাশের তুলনামূলক অবস্থান। মানুষের জ্ঞানের জগতে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরার কালের সমকালীনতায় পৌঁছা এবং সেখান থেকে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরার কালের সমকালীনতা পর্যন্ত হেঁটে আসতে মানব সভ্যতার মাত্রাগত অবস্থানের যে তুলনামূলক পরিবর্তন সাধিত হয়ে এসেছে, এরই ধারাবাহিকতায় কত ভাঙাগড়া কত পট পরিবর্তন ঘটে গেছে মানব সভ্যতায়। এগুলোই হয়তো ইতিহাসের নুড়ি-পাথর। এই কার্য-কারণ সম্পর্ক খুঁজতে খুঁজতেই মানুষের বা সভ্যতার এগিয়ে যাওয়া। এক বিশ্বাস থেকে আরেক বিশ্বাসে পদার্পণ, আবার পুরনো অকার্যকর হয়ে ওঠা সে বিশ্বাসকেও ছুঁড়ে ফেলে অন্য কোন আধুনিক বিশ্বাস বা মতবাদ আঁকড়ে নেয়া। তাই জাগতিক ঘটনাবলির কার্য-কারণ খোঁজার ইতিহাসই মূলত মানব সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাস। এসব করতে গিয়ে মানুষ কোন কার্য-কারণ সম্পর্কের যে আপাত ব্যাখ্যা তৈরি করে, সেটা করে তার সমকালীন জ্ঞানের স্তর বা বিন্যাস দিয়ে। সভ্যতা ক্রমশই এগিয়ে যায় বলে একশ’ বছর আগের ব্যাখ্যা আর আজকের ব্যাখ্যা তাই এক থাকে না, থাকতে পারে না।
জগতের যে ঘটনাগুলো মানুষ এড়িয়ে যেতে পারে না, তার কার্য-কারণ সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে সমকালীন আহরিত জ্ঞান দিয়েও যখন পরিপূর্ণভাবে তার রহস্য উন্মোচন করতে ব্যর্থ হয়, তখনই সে আশ্রয় নেয় কল্পনার বা কাল্পনিক ধারণা সৃষ্টির। আর এগুলোকে অদ্ভুতভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে যে সন্তোষজনক যুক্তির প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাকে পরিতৃপ্ত করতেই জন্ম নেয় কতকগুলো লোককথা, উপকথা, পুরাণ বা রূপকথার। আমাদের প্রচলিত ধর্মীয় কাহিনীগুলো এই পর্যায়ের বলে জাগতিক ঘটনাবলির কার্য-কারণ সম্পর্কের তৎকালীন ধর্মীয় ব্যাখ্যার সাথে মানব সভ্যতার হেঁটে হেঁটে অনেকদূর এগিয়ে আসা আধুনিক ব্যাখ্যার বিশাল ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে আজ। এরকমই আরেকটি বিষয় হলো তথাকথিত জ্যোতিষশাস্ত্র।
অজানার প্রতি মানুষের নিরাপত্তাহীনতার ভয় বা সন্দেহ চিরকালের। বিশাল প্রকৃতির মহাজাগতিক ক্ষমতার কাছে নিতান্তই অসহায় মানুষের এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকেই মনোজগতে জন্ম নেয়া শুভ-অশুভ জাতীয় সংস্কারগুলো জাগতিক সকল ক্রিয়াকর্মে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে মানুষকে করে তুলেছে অদৃষ্টবাদী। এই অদৃষ্টবাদিতাই হলো তথাকথিত জ্যোতিষশাস্ত্রের আসল পুঁজি। দৃশ্যমান গ্রহ-নক্ষত্রের আপেক্ষিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক শক্তি তথা আবহাওয়া ও জলবায়ুর মধ্যের আন্ত-সম্পর্কের যে নিয়মতান্ত্রিকতা, দীর্ঘকালীন পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে মানুষের আহরিত জ্ঞানে এ সত্য ধরা পড়েছে খুব স্বাভাবিকভাবেই। আর তাই এই সত্যের সাথে কাল্পনিক শুভ-অশুভের অলৌকিক সংস্কার যুক্ত হয়ে গড়ে ওঠা জ্যোতিষশাস্ত্রই নিয়ন্ত্রণ করেছে এতদঞ্চলের তৎকালীন মানুষের মনোভূমি। এছাড়া কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রকৃতি ও জলবায়ুর সাথে মানুষের সম্পর্ক এমনিতেই গভীর। এই প্রকৃতিনির্ভরতা মানুষকে বরাবরই আকৃষ্ট করেছে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট শুভ অশুভ পরিণতিগুলোর প্রতি। ফলে ‘যদি হয় চৈতে বৃষ্টি, তবে হবে ধানের সৃষ্টি।’ বা ‘আখ, আদা, পুঁই, এই তিনে চৈতি রুই’ জাতীয় কৃষিদর্শনভিত্তিক প্রবচনের সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এবং সাথে ‘সোম ও বুধে না দিও হাত, ধার করিয়া খাইও ভাত’ বা ‘মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা’ জাতীয় শুভ-অশুভ শঙ্কা মিশ্রিত অলৌকিক সংস্কার জাতীয় প্রবচনগুলোও প্রভাব বিস্তার করেছে ধর্মীয় রূপকথার আদলে। কিন্তু একটি নিরক্ষর কৃষিভিত্তিক সমাজে এসব লৌকিক জ্ঞানের ব্যবহারিক শৃঙ্খলা আনয়নে সুনির্দিষ্ট কিছু রীতি মেনে চলায় বাধ্য করার সাবলীল প্রক্রিয়া হলো ধর্মগাথার আদলে কাল্পনিক কোন মনোশাসক সৃষ্টি, যা একাধারে হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য ও আকর্ষণীয়। এরই বহিঃপ্রকাশ হয়তো উপকথার আদলে একজন লীলাবতী বা বিদুষী খনা নামের কিংবদন্তীয় কোন জ্যোতিষশাস্ত্রীর লোককাহিনীর সৃষ্টি ও এর ব্যাপ্তি। যথাযথ সময়ে যে কিনা কৃষিসম্পৃক্ত কোন প্রাজ্ঞ চাষার মুখ দিয়ে বলতে পারে- ‘বাঁশের ধারে হলুদ দিলে,/ খনা বলে দ্বিগুণ বাড়ে।’ কিংবা ‘শুনরে বাপু চাষার বেটা,/ মাটির মধ্যে বেলে যেটা,/ তাতে যদি বুনিস পটল,/ তাতে তোর আশার সফল’ ইত্যাদি। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্যরহিত কোন কাল্পনিক রূপকথা বা কিংবদন্তী নির্ভর ধারণা থেকে চূড়ান্ত কোন অনুসিদ্ধান্ত টানা হয়তো পরিমিত বিবেচনার প্রমাণ রাখে না।
আরেকটি সম্ভাবনা ও যুক্তিকে এক্ষেত্রে বেশ জোরালো মনে হতে পারে। তা হচ্ছে, খনা কোন ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়, প্রবচনের একটি বিশেষ রীতি বা ধারার নাম হলো খনার বচন। আর এই রীতি বা ধারাটি কী, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তবু খনা শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করে আমরা এর একটি অনুমান খুঁজে নেয়ার চেষ্ট করতে পারি।
‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ গ্রন্থে ‘খনা’ শব্দের দুটো অর্থ চিহ্ণিত করা হয়েছে। একটি হচ্ছে বিশেষণবাচক- নাকি সুরে কথা বলে এমন। অন্যটি বিশেষ্যবাচক এবং সেই রূপকথা আশ্রিত- বিখ্যাত বাঙালি মহিলা জ্যোতিষী; মিহিরের স্ত্রী। উক্ত অভিধানে খনার বচনের বিশেষ্যবাচক অর্থটি করা হয়েছে এভাবে- জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী চাষাবাদ, বৃক্ষরোপণ, গৃহনির্মাণ প্রভৃতি শুভাশুভ বিষয়ক সুপ্রচলিত প্রবচন যা খনার রচিত বলে প্রসিদ্ধ।
অর্থাৎ খনার বচনের একটি সুনির্দিষ্ট রীতি বা ধরন ইতোমধ্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী চাষাবাদ, বৃক্ষরোপণ, গৃহনির্মাণ, আবহাওয়া, জলবায়ু প্রভৃতি বিষয়সংশ্লিষ্ট শুভাশুভ বিষয়ক সুপ্রচলিত প্রবচনই খনার বচন। এক্ষেত্রে সংশয়ের কোন কারণ দেখি না। সংশয়ের কারণ থেকে যায় শুধু খনা শব্দ বা নামের যৌক্তিক উৎস নিয়েই। সম্ভবত এরও একটি চমৎকার সম্ভাব্যতা যাচাই করে নিতে পারি আমরা।
খনা (খন্ + আ) শব্দের মৌল শব্দ হচ্ছে খন। উল্লেখিত বাংলা অভিধানে এই ‘খন’ শব্দেরও দুটো ভিন্ন কিন্তু পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অর্থ চিহ্ণিত রয়েছে। একটি হলো- ক্ষণ শব্দের কোমল রূপ। আর ‘ক্ষণ’ অর্থ দেয়া আছে ‘মুহূর্ত’। অভিধানে খন শব্দের অন্য অর্থটি মুদ্রিত আছে এভাবে- ভবিষ্যৎ অর্থবোধক (হবে’খন, দেখব’খন)। {‘এখন’ শব্দের ‘এ’ লোপে; স. ক্ষণ}।
উপরোক্ত বিবেচনায় এখন ‘খনা’ শব্দটির ক্রিয়া-বিশেষণবাচক একটি লোকায়তিক অর্থ যদি এভাবে করা হয়, ভবিষ্যতের কোন বিশেষ (শুভাশভ) মুহূর্ত, কোথাও কি ভুল হবে ? যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে ‘খনার বচন’ শব্দযুগলের একটি বাচ্যার্থ দাঁড়ায় এরকম, যে বচনের মধ্য দিয়ে কোন বিষয়ের ভবিষ্যৎ শুভাশুভ মুহূর্ত নির্দেশিত হয় বা হয়েছে, তা-ই খনার বচন। ফলে আরো কিছু প্রশ্নেরও ধারণাগত যৌক্তিক ব্যাখ্যা পেয়ে যেতে পারি আমরা। খনার বচন যে কেবল খনা নামধারী সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিবিশেষেরই রচিত হতে হবে তা নয়। হতে পারে বিজ্ঞ কিছু নিরক্ষর লোক-চাষার। অথবা প্রাচীন কৃষিদর্শন-অভিজ্ঞ কিছু লোক-কবির। বা কৃষিনির্ভর কিছু চতুর ও প্রাজ্ঞ জ্যোতিষীর। তবে এ বচনগুলো যে বিভিন্ন কালের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনের মুখে মুখে ছড়া কাটার মতোই একগুচ্ছ লোকায়ত ভবিষ্যৎ বাণী, তাতে বোধকরি দ্বিমত করার খুব জোরালো অবকাশ থাকবে না। খনার বচনের সবগুলো প্রবচন হয়তো এখনো সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি বা খনার বচনের প্রকৃত সংখ্যাও সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণীত করা সম্ভব নয়। তবু খনার বচনের সেই সব বচন রচয়িতাকে যদি আমরা ‘খনা’ নামেই চিহ্ণিত করি, তাহলে বলতেই হয়, খনা হচ্ছে জনভাষ্যে মিশে থাকা আমাদের একগুচ্ছ লোক-ভাষ্যকার।